Posts

চিন্তা

দায় ও দরদের একই বয়ান আজ আবার কেন?

May 22, 2025

ফারদিন ফেরদৌস

116
View

হঠাৎ আজ কেন দেশের প্রতি দায় ও দরদের বর্ণনায় সবাই এমন এক সুরে গাইছেন? একযোগে কেন ঐক্যের আহ্বান? মাটি কি তবে কারও পায়ের তলা থেকে সরে যেতে শুরু করেছে?

অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম তাঁর সোশ্যাল হ্যান্ডেলে জানিয়েছেন: "ব্যক্তির আদর্শ, সম্মান ও আবেগের চেয়ে দেশ বড়। দেশপ্রেমিক শক্তির ঐক্য অপরিহার্য। অতীতে বিভাজন সৃষ্টিকারী যেসব বক্তব্য বা শব্দচয়ন আমার তরফ থেকে এসেছে, সেসবের জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। সরকারে আর একটি দিনও থাকলে, আমি অভ্যুত্থানের সকল শক্তির প্রতি সম্মান ও সংবেদনশীলতা বজায় রেখে কাজ করতে চাই। পুরোনো বিভাজনকামী শ্লোগান ও তকমাবাজি, যা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে প্রান্তিক করে তোলে, তা পরিহার করলেই ভবিষ্যতের রাষ্ট্র হয়ে উঠবে গণতান্ত্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক।
বাংলাদেশের শত্রুরা আজ ঐক্যবদ্ধ ও আগ্রাসী। দেশের সার্বভৌমত্ব ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো হুমকির মুখে। যারা জুলাই অভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছিলেন, তাদের সামনে এখন দীর্ঘ এক পরীক্ষা। এ পরীক্ষা ঐক্যের, ধৈর্যের। এবং এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতেই হবে।"

অপরদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আব্দুল্লাহ্ ফেসবুকে জানিয়েছেন: “জুলাইয়ের ফ্যাসিবাদ-বিরোধী সমস্ত শক্তিকে আহ্বান জানাচ্ছি -আমাদের মধ্যে যে অনাকাঙ্ক্ষিত বিভাজন এসেছিল, তা দেশের বৃহত্তর স্বার্থে মিটিয়ে ফেলতে হবে। স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার লড়াইয়ে আমাদের এক থাকতে হবে।
মনে রাখতে হবে, আওয়ামী ফ্যাসিবাদের পতনে দেশে-বিদেশে অনেকেই অখুশি। এই অখুশি শক্তিরাই আজকের এই অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতার পেছনে মদদদাতা।
আমরা এক হয়েছিলাম বলেই দেড় দশকের কঠোর ফ্যাসিবাদকে পরাজিত করতে পেরেছিলাম। যদি আবার খণ্ড-বিখণ্ড হই, তবে সেই পতিত ফ্যাসিবাদ এবং তার দেশি-বিদেশি দোসররা আমাদেরই তছনছ করার চক্রান্তে লিপ্ত হবে।
আমাদের ঐক্য কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষায় নয়; এই ঐক্য দেশ ও জাতির জন্য, আমাদের স্বদেশের পুনর্গঠনের জন্য।”

এইসব কথায় আদতে নতুন কোনো মানে নেই। বরং গেল কয়েকদিনে দুটি বড় ঘটনার প্রেক্ষিতে একযোগে এমনতর দায় ও দরদের বহিঃপ্রকাশ দেখা যাচ্ছে এবং সুর পরিবর্তনের ইঙ্গিত প্রতিভাত হচ্ছে।

প্রথমত, সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সম্প্রতি অফিসার্স অ্যাড্রেসে অন্তর্বর্তী সরকারের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন -মব ভায়োলেন্স কঠোরভাবে দমন, ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন, করিডর, বন্দর কিংবা অন্যবিধ  জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত কেবলমাত্র নির্বাচিত সরকারের দ্বারাই বাস্তবায়নযোগ্য। এই বক্তব্যের অভিঘাতে রাজনৈতিক সমীকরণ বদলে যেতে শুরু করেছে।

দ্বিতীয়ত, সরকারি আনুকূল্য পাওয়া নবীন রাজনৈতিক দল এনসিপি এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের ক্রমাগত বিরোধিতা সত্ত্বেও ঢাকার দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে বিএনপির তরুণ নেতা ইশরাক হোসেনের বহাল থাকার প্রশ্নে আদালত আজ বিএনপির পক্ষেই রায় দিয়েছেন। এতে এনসিপির রাজনীতিকরা এবং আসিফ মাহমুদ সজিব ভূঁইয়ার স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় গভীর হতাশায় নিমজ্জিত।

সবমিলিয়ে বিগত কয়েকদিনে আওয়ামী লীগের অবর্তমানে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি ও এনসিপির মধ্যে স্পষ্ট বিভাজন রেখা তৈরি হয়েছে। কেউ কাউকে সমীহ করছে না, একদম পাত্তা দিচ্ছে না। অথচ জুলাই আন্দোলনে হাসিনা সরকারের উৎখাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জামায়াত-শিবিরের সাথে সম অংশীদারের ভূমিকায় ছিল বিএনপি। শাহবাগে মব আন্দোলনে আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়ার পর ওই বিএনপির রাজনীতিও যেন এনসিপির চক্ষুশূল হতে বসেছিল।

এখন এসে দেখা যাচ্ছে এনসিপি তাদের দম্ভ ও হেডমগিরির জন্য পরোক্ষভাবে হলেও নমনীয়তা প্রকাশ করে সকল রাজনৈতিক পক্ষের সাথে সহাবস্থান ও ঐক্য কামনা করছে।

এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেছেন, মব তৈরি করে যদি হাইকোর্টের রায় নেওয়া যায় তাহলে এই হাইকোর্টের দরকার কি? ওদিকে বিএনপিও তাহলে বলতে পারে, শাহবাগে হাজারখানেক লোকের মব তৈরি করে যদি দল নিষিদ্ধ করা যায় তাহলে রাজনীতির দরকার কি? আর আমরা বলতে পারি মবোক্রিসির কাছে সবাই নাক বিন্দায়ে ফেলেছেন; এখন আর জঞ্জালের গয়না না পরে কারোরই উপায়ান্তর নাই।

এনসিপি এখন কিছুটা নমনীয় হয়ে উঠেছে, অন্তত কথার খোলসে হলেও। কিন্তু এ নমনীয়তা কি আত্মসমালোচনার ফল, না কি কৌশলের অংশ -তা সময়ই বলে দেবে।

মোদ্দাকথা হলো, জুলাই আন্দোলনের পর আওয়ামী লীগ বাদে অপরাপর রাজনৈতিক দলের যে সম্মিলনীর কথা ভাবা হয়েছিল, সবার অংশগ্রহণে রাষ্ট্র সংস্কারের বয়ান দেয়া হয়েছিল; সেসব আলাপের এতটুকু মূল্য আর নাই।

প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রায় এক বছর পূর্ণ হতে চললেও সংস্কার বা নতুন কোনো রাজনৈতিক বন্দোবস্তের সামান্য আলোকরেখা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। তাই দায় ও দরদের বয়ানে যতই ঐক্যের ঢোল বাজানো হোক, সত্যটা হলো -বিশ্বাসের কাঁচ যখন একবার ভাঙে, তাকে জোড়া লাগানোর আর কোনো উপায় থাকে না।

লেখক: সাংবাদিক
২২ মে ২০২৫

Comments

    Please login to post comment. Login