২১০৫ সাল। পৃথিবী আর আগের মতো নেই। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অনেক দেশ ডুবে গেছে, আর বাকি অংশগুলো কঠোর নিয়মে পরিচালিত হচ্ছে। পৃথিবী এখন পাঁচটি শক্তিধর জোটে বিভক্ত। প্রযুক্তির উন্নতি হয়েছে অনেক, কিন্তু মানুষের মধ্যে বিশ্বাস, ভালোবাসা আর মানবতা হারিয়ে গেছে প্রায়।
তবে, এই ধ্বংসস্তূপের মধ্যেই জন্ম নেয় এক ব্যতিক্রমী শিশু—নাম তার ইরান। ইরান জন্ম থেকেই একটু আলাদা। তার চোখে একটি অদ্ভুত আলো ছিল। তার জন্মের সময়ই আকাশে বিশাল এক নীল উল্কাপিণ্ড দেখা গিয়েছিল, যেটা নাকি শেষ “জ্যোতিষ্ক” বলে বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছিল। অনেকে বিশ্বাস করত, সেই জ্যোতিষ্কের সাথে ইরানের কোনো যোগ আছে।
ইরানের বয়স যখন দশ, তখন তার মা-বাবা এক রহস্যময় দুর্ঘটনায় মারা যান। সরকার বলেছিল বিদ্যুৎচালিত গাড়ির বিস্ফোরণ, কিন্তু ইরান জানত কিছু একটা গড়বড় আছে। এরপর থেকে সে থাকে রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত অনাথশালায়, যেখানে বাচ্চাদের রোবটিক, নিষ্ঠুর প্রশিক্ষণ দিয়ে “ডেটা সোলজার” বানানো হয়—এমন যোদ্ধা যারা মানুষের চেয়ে বেশি কম্পিউটার, কম্পিউটারের চেয়ে বেশি হৃদয়হীন।
কিন্তু ইরান ছিল আলাদা। সে স্বপ্ন দেখত। আকাশে উড়ে যাওয়ার, অন্য গ্রহে পা রাখার, মানুষের হৃদয়ে ভালোবাসা ফিরিয়ে আনার। তার এই স্বপ্নগুলো তাকে প্রায়ই সমস্যায় ফেলে দিত।
একদিন রাতে, সে তার ঘুমের মধ্যে এক বিস্ময়কর স্বপ্ন দেখে। এক বৃদ্ধা, যার মুখ ঢাকা কিন্তু চোখ দুটি যেন তার আত্মার গভীরতা স্পর্শ করে, বলছে:
— “তুমি শেষ জ্যোতিষ্কের উত্তরসূরি। তোমার মধ্যে আছে সেই শক্তি, যা হয়তো পুরো মানবজাতিকে আবার আলো দেখাতে পারে।”
ইরান ভেবে পায় না, এ স্বপ্ন না কি বাস্তব। কিন্তু ঘুম ভাঙার পর সে দেখে তার ডান হাতের তালুতে জ্বলজ্বলে একটি চিহ্ন—একটি ঘূর্ণায়মান নক্ষত্রের মতো। যেটা সে আগে কখনো দেখেনি।
এরপর থেকে শুরু হয় এক অদ্ভুত যাত্রা।
অন্তর্জালের নকশা
ইরান অনাথশালার কম্পিউটার ল্যাবে গোপনে একটি প্রাচীন ফাইল খুঁজে পায়, যেটা ‘আর্কাইভ জিরো’ নামে চিহ্নিত। এই ফাইলে ছিল একটি মানচিত্র—ভেঙে পড়া এক মহাজাগতিক গবেষণা কেন্দ্রের অবস্থান, নাম “অন্টারেস ফ্যাসিলিটি”। বলা হয়, সেখানে একসময় এমন একটি ডিভাইস তৈরি হয়েছিল যা “মানব হৃদয়কে পুনরায় জাগ্রত করতে পারে”। সেই ডিভাইসের নাম “নিউরো-লুমেনা”।
ইরান বুঝতে পারে, তাকে এই যাত্রায় যেতে হবে। সে ঠিক করে, যেভাবেই হোক অনাথশালা থেকে পালাবে।
পালানোর রাত
রাতের অন্ধকারে, যখন সমস্ত নিরাপত্তা ড্রোন গভীর পর্যবেক্ষণে, তখন ইরান তার বানানো নিজস্ব ছায়া-ক্লোন প্রযুক্তি ব্যবহার করে একটি ছদ্মরূপ তৈরি করে। যেটা মূলত তার মতো দেখতে একটি হ্যালোগ্রাফিক বিভ্রম। সে এই প্রযুক্তি দিয়ে নিরাপত্তা ফাঁকি দিয়ে পালায়।
কিন্তু বাইরে পৃথিবী আর তার চেনা নেই। রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় সাইবার-চোর, কৃত্রিম প্রাণীরা শিকার করে মানুষের আবেগ। ইরান একটি পুরনো রেললাইনের ধারে এক বৃদ্ধ বিজ্ঞানীকে খুঁজে পায়—ডক্টর সালিম, যিনি আগে “অন্টারেস ফ্যাসিলিটি”-র অংশ ছিলেন।
ডক্টর সালিম প্রথমে ইরানকে বিশ্বাস করতে চায় না। কিন্তু যখন সে ইরানের হাতের চিহ্নটি দেখে, সে বিস্ময়ে থেমে যায়।
— “এই চিহ্ন শুধু মাত্র প্রকল্প ‘লুমেনা’র বংশধরদের গায়ে আসে। তুমি কি জানো, তুমি কে?”
ইরান মাথা নাড়ে। ডক্টর সালিম তার গল্প শোনান। বলেন, অনেক বছর আগে একটি মহাজাগতিক রশ্মি পৃথিবীতে আঘাত হানে, যার তরঙ্গে কিছু শিশুর DNA বদলে যায়। তারা ছিল ভবিষ্যতের আশা, কিন্তু সরকার এই শিশুদের হত্যা করে ‘ঝুঁকি’ মনে করে। কেবল একজন পালিয়ে বেঁচেছিল—ইরানের মা।
তখনই ইরান বুঝতে পারে, তার যাত্রা শুধুই নিজের জন্য নয়। এটা সমগ্র মানবজাতির জন্য।
অন্টারেসে প্রবেশ
অবশেষে তারা অন্টারেস ফ্যাসিলিটির ধ্বংসস্তূপে পৌঁছায়। জায়গাটি এখন একটি নিষিদ্ধ এলাকা, যেখানে প্রবেশ মানেই মৃত্যু। সেখানে পাহারা দেয় “ড্রেড গার্ডিয়ান”—একটি মানবাকৃতি AI রোবট, যা নিজেই নিজের নিয়মে চলে।
ইরান, তার প্রযুক্তি আর ডক্টর সালিমের সহায়তায় ফ্যাসিলিটিতে প্রবেশ করে। সেখানে সে দেখে বিশাল এক ডোমের ভিতরে রাখা নিউরো-লুমেনা—একটি স্ফটিকের মতো বস্তু, যার চারপাশে জ্বলছে মৃদু নীল আলো।
কিন্তু ঠিক তখনই ড্রেড গার্ডিয়ান তাদের আক্রমণ করে।
সংঘর্ষ এবং আত্মত্যাগ
ড্রেড গার্ডিয়ানকে মোকাবিলা করতে গিয়ে ডক্টর সালিম গুরুতর আহত হন। তিনি ইরানকে বলেন:
— “তুমি জানো, নিউরো-লুমেনা শুধু তাদের কাজ করে, যাদের হৃদয় একেবারে নির্মল... তুমি তা-ই। নিয়ে যাও এটা। ফিরে যাও পৃথিবীতে, মানুষের মাঝে আলো ফেরাও।”
ইরান নিজেকে লুমেনার সামনে দাঁড় করায়। তার হৃদয়ের স্পন্দনে সাড়া দিয়ে নিউরো-লুমেনা সক্রিয় হয়। সেই মুহূর্তে চারপাশে বিশাল আলো ছড়িয়ে পড়ে। পুরো ফ্যাসিলিটি কেঁপে ওঠে। ড্রেড গার্ডিয়ান ধ্বংস হয়ে যায়।
ইরান মূর্ছা যায়।
আলো ফিরে আসা
ইরান যখন জেগে ওঠে, সে দেখে সে একটি সবুজ উপত্যকায় শুয়ে আছে। তার চারপাশে শিশু, বৃদ্ধ, নারী—সবাই আছে। কেউ কাঁদছে, কেউ হাসছে।
সে জানতে পারে, নিউরো-লুমেনার তরঙ্গ পৃথিবীর সকল মানুষের আবেগ-নিয়ন্ত্রণকারী চিপ ধ্বংস করে দিয়েছে। মানুষ আবার অনুভব করতে পারছে—ভালোবাসা, দুঃখ, আনন্দ, ঘৃণা—সব কিছু।
সরকার পতন করেছে। নতুন পৃথিবীর সূচনা হয়েছে।
ইরান চেয়ে থাকে আকাশের দিকে। ঠিক তখনই আবার এক নতুন জ্যোতিষ্ক দেখা যায়।
সে জানে, তার যাত্রা শেষ নয়। বরং শুরু হলো মাত্র।
[সমাপ্ত]