রোমান ইতিহাসে সবচেয়ে বিখ্যাত পদত্যাগের ঘটনা হলো সম্রাট ডায়োক্লেশিয়ানের স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ত্যাগ, যা ইতিহাসে বিরল একটি দৃষ্টান্ত। সেনাবাহিনী থেকে উঠে আসা ডায়োক্লেশিয়ান ৩০৫ খ্রিস্টাব্দে শাসনভার থেকে অবসর নিয়ে বর্তমানে ক্রোয়েশিয়ায় অবস্থিত স্প্লিট শহরে নিজ প্রাসাদে (Diocletian’s Palace) চলে যান।
প্রাচীন ভারতে কিছু রাজা ও সম্রাট ধর্ম বা আত্মিক মুক্তির খোঁজে সিংহাসন ছেড়ে ‘বাণপ্রস্থ’ গ্রহণ করতেন, যেমন সম্রাট অশোক কলিঙ্গ যুদ্ধের পর বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হন ও আগ্রাসন বন্ধ করেন, যদিও তিনি রাজনীতি পুরোপুরি ছাড়েননি।
চীনা সমাজে কনফুসিয়ান নীতির কারণে অনেক সময় নৈতিক দায় স্বীকার করে কর্মকর্তা ও সামন্তরা পদত্যাগ করতেন, যদিও তা অনেক সময় আনুষ্ঠানিকতা রক্ষার অংশ ছিল।
ইসলামী শাসনব্যবস্থায় পদত্যাগের ঘটনা অত্যন্ত বিরল; তবে আব্বাসীয় ও উমাইয়া আমলে রাজনৈতিক সংকট, গৃহযুদ্ধ বা বিদ্রোহের চাপে কিছু খলিফা কার্যত ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন, যদিও তা স্পষ্ট স্বেচ্ছায় পদত্যাগ ছিল না। সার্বিকভাবে প্রাচীন ও প্রাক-আধুনিক যুগে নেতাদের পদত্যাগ ছিল ব্যতিক্রম, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা মৃত্যু, ক্ষমতা দখল বা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা হারাতেন। আধুনিক কালের আগে ‘পদত্যাগ’ গণতান্ত্রিক নৈতিকতার নয়, বরং ব্যক্তিগত সংকট বা চাপের ফলাফল হিসেবে দেখা দিত।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে নেতৃবৃন্দের পদত্যাগ সবসময়ই গভীর রাজনৈতিক পরিবর্তনের সূচক হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের পদত্যাগের ভাবনা দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে, অতীতের উদাহরণগুলো পর্যালোচনা করে বর্তমান পরিস্থিতির মূল্যায়ন করা প্রয়োজন।
প্রথম আলো এ বিষয়ে আজকের লিড নিউজে বলেছে, ক্ষোভ ও হতাশা থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস পদত্যাগ করতে চাইছেন, এমন খবর তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি করেছে সারা দেশে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের নিয়মিত বৈঠক শেষে অনির্ধারিত আলোচনায় তাঁর পদত্যাগের ভাবনার কথা বলেন। জানা যায়, এ সময় তিনি সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগে নানা প্রতিবন্ধকতার কথা বলেন। প্রায়ই সড়ক আটকে আন্দোলন, সংস্কারসহ বিভিন্ন বিষয়ে দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য না হওয়া, রাষ্ট্রীয় কাজে নানা পক্ষের অসহযোগিতাসহ দেশের বিরাজমান পরিস্থিতিতে ক্ষোভ ও হতাশা ব্যক্ত করেন তিনি। অধ্যাপক ইউনূসের পদত্যাগের ভাবনার কথা জানাজানি হওয়ার পর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকেই বিভিন্ন মহলে নানা আলোচনা ও উদ্বেগ সৃষ্টি হয়।
এর আগের দিন বুধবার ঢাকা সেনানিবাসে ‘অফিসার্স অ্যাড্রেস’ অনুষ্ঠানে দেওয়া সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের কিছু বক্তব্য জনসমক্ষে প্রকাশ পায়। তাতে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান, তার মাধ্যমে একটি নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠাসহ জাতীয় নিরাপত্তা-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বক্তব্য ছিল।
বাংলাদেশের ইতিহাসে উচ্চপর্যায়ের পদত্যাগ সবসময়ই রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রতিফলন হয়েছে। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মর্মন্তুদ হত্যাকাণ্ডের পর সামরিক শাসনের সূচনা হয়। পরবর্তীতে, ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বেদনাদায়ক হত্যাকাণ্ড এবং ১৯৮২ সালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ক্ষমতা দখল দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে। ২০০৭ সালে সেনাবাহিনীর সমর্থনে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করেছিল। রাজনীতিতে দুই বছরের জন্য মাইনাস টু ফর্মুলা কার্যকর থাকে।
২০২৪ সালের আগস্টে গণরোষে সরকার থেকে শেখ হাসিনার পতন ও দেশত্যাগের পর, ছাত্র আন্দোলনের প্রেক্ষিতে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তবে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্যের অভাব, সংস্কার প্রক্রিয়ার অগ্রগতির স্থবিরতা, বন্দর ও করিডরসহ রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে গড়বড়, সেনাবাহিনী এবং বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির পক্ষ থেকে ডিসেম্বর ২০২৫-এর মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের চাপের মুখে তিনি পদত্যাগের ইচ্ছা প্রকাশ করেন।
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)র আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম জানিয়েছেন, 'প্রফেসর ইউনূস রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতার অভাবে হতাশ এবং বর্তমান পরিস্থিতিতে কার্যকরভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না। তবে তিনি পদত্যাগের মতো সিদ্ধান্ত না নিতে অনুরোধ করেছেন।'
এ বিষয়ে ঢাকা থেকে সাইফ হাসনাত দ্য নিউইয়র্ক টাইমসে ২৩ মে 'Bangladesh’s Leader Threatens to Resign Over Election Pressure'-শীর্ষক একটি সংবাদ পরিবেশন করেছেন।
ওই প্রতিবেদনে দ্য নিউইয়র্ক টাইমসকে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ফেলো মোবাশ্বার হাসান বলেন, ‘মুহাম্মদ ইউনূস একজন চমৎকার ব্যাংকার হতে পারেন, প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রেও তিনি দারুণ হতে পারেন; কিন্তু তাঁর যে ঘাটতি রয়েছে, দিনের পর এটা স্পষ্ট হচ্ছে যে তাঁর দৃঢ় ও শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব নেই।’ তার বদলে মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর উপদেষ্টাদের দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হতে পারেন বলে মনে করেন মোবাশ্বার হাসান।
অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করা একজন কর্মকর্তা টাইমসকে বলেন, দেশের গণতন্ত্রকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে যাঁদের তাঁকে সাহায্য করার কথা ছিল, তাঁদের কেউ কেউ তাঁকে উপেক্ষা করছেন বলে অধ্যাপক ইউনূস মনে করছেন। ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন হওয়া উচিত গত বুধবার সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের এমন বক্তব্যের পর তিনি ধৈর্য হারিয়েছেন বলে মনে হচ্ছে।
অধ্যাপক ইউনূস এর আগে বলেছিলেন, ২০২৫ এর ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুন নাগাদ দেশ নির্বাচন আয়োজনের জন্য প্রস্তুত হতে পারে। তবে তিনি কোনো সুনির্দিষ্ট সময়সীমা বেধে দেননি। তিনি তাঁর মন্ত্রিসভাকে বলেছেন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশ একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত বলে তিনি মনে করেন না।
কিন্তু বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হোক এমনটা প্রকাশ্যেই বলে দিয়েছে। কার্যত এটা নিয়েই প্রফেসর ইউনূসের মনে গোস্যা তৈরি হয়েছে। তবে এটা প্রফেসর ইউনূসের তরফে কোনো কৌশলগত স্ট্যান্ড কিনা তা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেছে বিএনপি।
বলা হচ্ছে গুটিকয়েক স্বার্থবাদী লোক যথাযথ সংস্কার শেষে ঘোষিত টাইম ফ্রেমের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান থেকে প্রফেসর ইউনূসের মনোভঙ্গি মিসগাইড করে অন্তর্বর্তী সরকারকে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় রাখতে চাইছে।
এমন বাস্তবতায় প্রফেসর ইউনূস যদি সত্যি দেশ শাসন ছেড়ে আগের কর্মযজ্ঞে ফিরে যান তাতে কি স্বার্থান্বেষী মহলের ষড়যন্ত্র বন্ধ হবে? আমরা মনে করে তা আরো দীর্ঘমেয়াদে বাড়বে। প্রফেসর ইউনূসের চেয়ে সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য মানুষ এই মুহূর্তে নেই। সবাই যে যার মনের মতো মানুষকেই পছন্দ করে। আর ঐকমত্যে না পৌঁছানো গেলে আওয়ামী লীগ পরবর্তী সময়ে এই জাতির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ টোটালি অন্ধকারে বিলীন হতে পারে।
অধ্যাপক ইউনূসের পদত্যাগ দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করতে পারে। কাজেই অতীত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত জাতীয় ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের জন্য কাজ করা। এটি শুধুমাত্র বেখেয়ালে ব্যক্তিগত নেতৃত্বের পরিবর্তনের মাধ্যমে নয়, বরং প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্ভব। সবাইকে নিয়ে সমমর্যাদায় আলোকের ঝর্ণাধারায় স্নান করতে চাইলে দেশের স্বার্থে সবাইকে প্রজ্ঞার পরিচয় দিতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক
২৪ মে ২০২৫