ঢাকার আকাশ আজ কিছুটা গাঢ় মেঘে ঢাকা। সন্ধ্যার আলো নিভে এসেছে ধীরে ধীরে। সেই দিনের পর আবার ঠিক এক সপ্তাহ কেটে গেছে। রাফি আবার হাঁটছে, সেই পুরনো রাস্তা ধরে। অফিস শেষে ক্লান্তি আর একরাশ অস্থিরতা নিয়ে তার পা আজ আবার “Café Melancholy”-র দিকে।
ভেতরে ঢুকেই চোখ যায় জানালার ধারে—সেই জায়গায়, যেখানে প্রথম দেখা হয়েছিল আয়রার সঙ্গে। আজও সে একইভাবে বসে, ডায়েরি হাতে।
রাফির মুখে হাসি ফোটে। কেমন যেন আত্মীয়তা তৈরি হয়ে গেছে এই চেনা-অচেনা মেয়েটির সঙ্গে। যেন আয়রা একজন না, বরং একটা অনুভব। একটা আকাশের নিচে পাশাপাশি হেঁটে চলা দুটো মন।
রাফি ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়, আয়রার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
— “তোমার ডায়েরিতে জায়গা রেখেছিলে?”
আয়রা মুখ তুলে চেয়ে হেসে বলে,
— “রেখেছিলাম। আজকের পাতাটা এখনো খালি।”
রাফি বসে পড়ে। এই ছোট্ট কফি শপের ভিতরে, এক কাপ কফি আর মনখারাপের নীরব সুর যেন ধীরে ধীরে গাঢ় হতে থাকে।
— “আজ কেমন আছো?” আয়রা জিজ্ঞেস করে।
— “ভালো... অন্তত আগের থেকে অনেকটা ভালো,” রাফি উত্তর দেয়।
তারপর একটু থেমে বলে,
— “তুমি তো বলেছিলে, কেউ চলে গেছে। সে কি ফিরে আসবে না?”
আয়রার চোখ স্থির হয়ে আসে। জানালার বাইরের দিকে তাকিয়ে সে বলে,
— “না, কেউ কেউ ফেরে না। কিন্তু থেকে যায়, শব্দের ভেতরে। অভ্যাসের মাঝে। ডায়েরির পাতায়। স্মৃতির ভেতরে। যেমন তুমি... আজ আমার অভ্যাসে ঢুকে পড়েছো।”
কথাগুলো এত সহজে বলল আয়রা, যেন সে বহুদিন ধরে প্রস্তুত হয়ে ছিল এ কথা বলার জন্য।
রাফি চুপ করে যায় কিছুক্ষণ। তার চোখে এখন আর কষ্টের ঘন ছায়া নেই, আছে একধরনের প্রশান্তি। হয়তো কাউকে পাওয়া মানেই শুধু একসঙ্গে থাকা নয়, বরং কারো সঙ্গে অনুভব ভাগ করে নেওয়াটাও পাওয়া।
কফি এসে যায়। দুজনেই কাপ হাতে নেয়। আয়রা এবার বলে,
— “তুমি কি কখনো ভেবেছিলে, তুমি আর কারো জন্য নতুন কেউ হয়ে উঠতে পারবে?”
রাফি একটু হেসে বলে,
— “না, ভাবিনি। ভাবতাম আমার সবটুকু শেষ হয়ে গেছে নীলার সাথে। কিন্তু আজ... আজ মনে হচ্ছে আমি আবার শুরু করতে পারি। হয়তো ধীরে ধীরে।”
আয়রার মুখে একরাশ নরম হাসি।
— “তোমার গল্পে একটা ছায়া আছে রাফি, কিন্তু ছায়া মানেই অন্ধকার নয়। ছায়া মানে একরকম ঠান্ডা প্রশ্রয়।”
তাদের মাঝে আবার কিছুটা নীরবতা। বাইরে তখন হালকা বৃষ্টি। বৃষ্টির শব্দ কাচে পড়ে, যেন মনে করিয়ে দেয়—প্রকৃতিরও একটা ছন্দ আছে, যেটা সময়ের সাথে বদলায়, ঠিক ভালোবাসার মতো।
আয়রা এবার ডায়েরি খুলে একটি পাতায় কিছু লিখতে শুরু করে। রাফি দেখে, তার নামের প্রথম অক্ষরটা সেখানে।
— “তুমি কি আজকেই লিখছো আমার গল্প?”
আয়রা বলে,
— “তোমার গল্প না। আমাদের গল্প। আজ থেকে শুরু হচ্ছে।”
এরপর প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যায় দেখা হয় দু’জনের। কখনও কফি শপে, কখনও রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে, কখনও বইয়ের দোকানে পুরনো বই ঘাঁটতে ঘাঁটতে।
আয়রা একদিন বলে,
— “তুমি কি জানো, ভালোবাসা সবসময় আগুনের মতো না? এটা কখনও কখনও ধোঁয়ার মতো। একটু একটু করে মিশে যায় তোমার চারপাশে।”
রাফি শুধু তাকিয়ে থাকে। সে বুঝতে পারে, আয়রা যে কেবল একজন মানুষ না, সে এক ধরণের নতুন পথ—যার গন্তব্যে না হোক, অন্তত পথচলাটা সুন্দর।
একদিন রাফি আয়রাকে নিয়ে যায় তার পুরনো এক জায়গায়—বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই লাইব্রেরি যেখানে সে আর নীলা একসময় গল্প করত।
— “তুমি ভয় পাওনি আমাকে এখানে আনতে?” আয়রা জানতে চায়।
রাফি একটু চুপ করে বলে,
— “ভয় পেতাম আগে। এখন মনে হয়, পুরনো জায়গাগুলোরও নতুন অর্থ হতে পারে, যদি পাশে নতুন কেউ থাকে।”
আয়রা চুপচাপ তার হাত ধরে ফেলে। প্রথমবারের মতো।
সেই স্পর্শে কোনো তীব্রতা নেই। নেই কোনো নাটকীয়তা। আছে কেবল একধরনের মৃদু আশ্বাস—“আমি আছি।”
বছরের শেষ বিকেল। ঢাকার শীতল বাতাসে আজ কিছুটা কাঁপন আছে। রাফি আর আয়রা বসে আছে গুলশানের এক শান্ত পার্কে। দুজনের মাঝখানে একটা ছোট্ট থার্মোস, কফি ঠান্ডা হয়ে এসেছে।
আয়রা বলে,
— “তুমি কি আজো কখনও নীলাকে মনে করো?”
রাফি সৎভাবে উত্তর দেয়,
— “হ্যাঁ, করি। তবে সেটা আর আগের মতো করে না। এখন মনে হয়, নীলা আমার গল্পের একটা অধ্যায় ছিল, শেষ পৃষ্ঠাটা তুমি।”
আয়রার চোখে জল আসে, সে চুপচাপ ডায়েরির একটা পাতা খুলে রাফির সামনে রাখে। সেখানে লেখা—
“কখনও ভাবিনি, মন খারাপের কফি একদিন নতুন জীবনের স্বাদ এনে দেবে।”
রাফি তাকিয়ে বলে,
— “তুমি কি জানো, তোমার ডায়েরিই আমাদের প্রেমপত্র হয়ে উঠেছে।”
আয়রা হেসে মাথা ঝাঁকায়।
এর কয়েকদিন পর, রাফি কফি শপে এসে দেখে আয়রা নেই। ডায়েরির পাতাগুলো ছড়িয়ে আছে টেবিলে, কিন্তু সে নেই। বারে গিয়ে জানতে পারে, আয়রা বলেছে সে হয়তো আজ আসবে না।
রাফির বুকটা হঠাৎ ধক করে ওঠে। ভয়, অজানা শঙ্কা, পুরনো কোনো দিন যেন ফিরে এসেছে।
তবে টেবিলের উপর রাখা একটা কাগজে লেখা— “আজকে আমার পুরনো কিছু বন্ধ করতে হবে। তুমি অপেক্ষা করো, আমি ফিরে আসব।”
রাফি গভীর নিশ্বাস নেয়। চোখ বন্ধ করে।
এবার সে জানে—সব গল্পের শেষেই হয়তো কান্না থাকে না। কোনো কোনো গল্পের শেষ হয় অপেক্ষায়।
আর অপেক্ষা মানেই ভালোবাসা।
#চলিত