ঢাকার জানুয়ারি সকাল। কুয়াশার চাদরে মোড়ানো পথ, ঠান্ডা বাতাসে গায়ে কাঁটা দিয়ে যায়। শহরের চিরচেনা কোলাহলেও যেন আজ একটা নীরবতা, ঠিক যেমনটা রাফির মনেও।
সপ্তাহখানেক হতে চললো আয়রা নেই। কোনো বার্তা নেই, কোনো কল নেই। কেবল সেই একটিমাত্র কাগজে লেখা বাক্য—
“আজকে আমার পুরনো কিছু বন্ধ করতে হবে। তুমি অপেক্ষা করো, আমি ফিরে আসব।”
রাফি যেন প্রতিটা শব্দ হৃদয়ে কেটে রেখেছে। “পুরনো কিছু” বলতে সে কী বোঝালো? কোনো অসমাপ্ত সম্পর্ক? কোনো ভুল? রাফি জানে না। শুধু জানে, প্রতিদিন সন্ধ্যায় সে ক্যাফে মেলানকলিতে যায়, জানালার ধারে সেই জায়গায় বসে। আয়রার মতোই ডায়েরি নিয়ে, কিন্তু পাতা খোলে না। কারণ লেখার কিছু নেই—সব অপেক্ষার মধ্যে আটকে।
---
একদিন সন্ধ্যায়, ক্যাফের দরজার ঘণ্টা বেজে ওঠে। রাফি স্বাভাবিকভাবেই চোখ তুলে তাকায়। তবে এবার কেউ আসে না আয়রার মতো হালকা পায়ে। আসে একজন বৃদ্ধা, ধীরে ধীরে হেঁটে যায় ক্যাশ কাউন্টারের দিকে। রাফি চোখ নামিয়ে আনে। কিন্তু হঠাৎ এক মুহূর্তে সে অনুভব করে—আজকেও যদি আয়রা না আসে?
সে উঠে দাঁড়ায়, বাইরে আসে। কুয়াশা জমে আছে গাড়ির গায়ে। হাঁটতে থাকে নিরুদ্দেশের মতো, শহরের ভেতর একাকীত্ব নিয়ে। হঠাৎ মনে পড়ে, আয়রা একবার বলেছিল—
“কখনও যদি আমায় খুঁজে না পাও, আমার শব্দে খুঁজে নিও। সেগুলো ঠিকানা হয়ে উঠবে।”
রাফি ডায়েরি খুলে আয়রার লেখাগুলো পড়ে। একটি পাতায় লেখা ছিল:
> “পুরনো শহরের শেষ কোণায় যেখানে নিঃশব্দে বই পড়ে সময়, আমি ওখানে যাই—পুরনো নিজেকে ছেড়ে নতুন একটা নিজেকে খুঁজতে।”
সে বুঝতে পারে, এই লাইনটা গুলিস্তানের সেই পুরনো বইপাড়ার কথা। ছোট ছোট স্টলে পুরনো বই বিক্রি হয় যেখানে, একসময় আয়রা ওখানে একসাথে গিয়েছিল। তার বুকের ভেতর একটা টান পড়ে।
---
রাফি পৌঁছে যায় সেই জায়গায়। শহরের কোলাহল সত্ত্বেও বইয়ের পাতার গন্ধে একটা শীতলতা মিশে থাকে এখানে। ঘুরতে ঘুরতে একটা দোকানের সামনে দাঁড়ায়, যেখানে এক বৃদ্ধ বই বিক্রি করেন। রাফি জিজ্ঞেস করে,
— “এই জায়গায় আপনি কি একজন মেয়েকে দেখেছেন নিয়মিত আসতে, পাতলা শাল, ডায়েরি হাতে?”
বৃদ্ধ চোখ সরু করে দেখে, তারপর মাথা নাড়ে।
— “হ্যাঁ, মাঝে মাঝে আসত। চুপচাপ বই দেখে চলে যেত। শেষবার এসেছিল প্রায় পাঁচদিন আগে। কিছু চিঠির বই কিনে নিয়ে গেছে।”
রাফি আশ্চর্য হয়। চিঠির বই? সে একবার আয়রার ডায়েরিতে পড়েছিল:
> “চিঠি কখনও কখনও সেই ভাষা, যা আমরা সামনে দাঁড়িয়ে বলতে পারি না। তাই আমি লিখি।”
হয়তো সে কিছু বলতে চেয়েছে—লিখে গেছে কোথাও।
---
রাফি আবার ক্যাফেতে ফিরে আসে। অস্থিরতা নিয়ে চারপাশে খোঁজে, কিছু কি সে মিস করেছে? হঠাৎ চোখ পড়ে টেবিলের নিচে একটা পাতার কোণে, কোনোভাবে চাপা পড়ে ছিল। সে তুলে নেয়।
পাতায় লেখা আয়রার হাতে:
> “রাফি,
তোমার সাথে কাটানো প্রতিটা সন্ধ্যা আমার নিঃশব্দ জীবনের এক নতুন অধ্যায় ছিল। কিন্তু আমি অতীত ছেড়ে আসিনি পুরোপুরি।
আমার একটা অসমাপ্ত সম্পর্ক ছিল। কেউ একজন ছিল, যে আমার গল্প শুরু করেছিল, কিন্তু কখনো শেষ করতে পারেনি।
সে হঠাৎ ফিরে এসেছে। উত্তর চাইছে।
আমি জানি, তাকে না বলাটা আমার নতুন গল্পের প্রতি দায়বদ্ধতা।
তবে তাকে মুখোমুখি না হলে আমি কখনোই মুক্ত হবো না।
আমি যাচ্ছি তাকে শেষবারের মতো বিদায় জানাতে।
আমি ফিরব, যদি তুমি তখনো অপেক্ষা করো।”
রাফি কাগজটা বুকের কাছে চেপে ধরে। তার চোখে জল আসে না, আসে একধরনের কঠিন প্রশান্তি। সে জানে, ভালোবাসা মানে শুধু একসাথে থাকা না, বরং কাউকে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার স্বাধীনতাও দেওয়া।
---
দিন গড়ায়। আবার একটা সপ্তাহ কেটে যায়। এই সময়ের মধ্যে রাফি ধীরে ধীরে নিজের জীবনেও কিছু পরিবর্তন আনে। সে আবার লিখতে শুরু করে। আয়রাকে নিয়ে, তাদের কফির সন্ধ্যা নিয়ে, তাদের নীরবতা নিয়ে।
একদিন ক্যাফেতে বসে সে নিজের লেখা পড়ে, তখন এক অচেনা কণ্ঠস্বর বলে ওঠে—
— “তুমি এখন আমার গল্প লিখছো?”
রাফি চোখ তুলে তাকায়।
আয়রা।
সে দাঁড়িয়ে আছে, হালকা হাসি মুখে, চোখে সেই পুরনো ক্লান্তি নেই। বরং একধরনের নির্ভারতা।
রাফি উঠে দাঁড়ায়। কোনো কথা বলে না। শুধু এক পা এগিয়ে এসে আয়রার হাতে হাত রাখে। এবার কোনো প্রশ্ন নেই। কোনো ‘তুমি কোথায় ছিলে’ নেই। আছে কেবল এই মুহূর্ত।
আয়রা বলে,
— “সব বন্ধ করেই এসেছি। পুরনো পাতা বন্ধ না করলে তো নতুন লেখা যায় না, তাই না?”
রাফি মাথা নাড়ে।
— “তুমি জানো, আমি ভয় পেয়েছিলাম। ভাবছিলাম যদি তুমি না আসো?”
— “আমি বলেছিলাম, আমি আসব। শুধু চাইছিলাম, ফিরে আসার সময় যেন আমি নিজেকে নিয়ে আসতে পারি, অসম্পূর্ণতাকে না।”
রাফি এবার ডায়েরি খুলে আয়রাকে দেখায় তার লেখা প্রথম কবিতাটি—
> “একটা চেয়ার,
একটা কফির কাপ,
একটা বিকেল,
আর তুমি—
এই চারটেই ছিল আমার শান্তি।
তোমার অনুপস্থিতি শুধু অভ্যাস নয়,
তুমি নিজেই হয়ে উঠেছিলে আমার গল্পের ভিতরকার নীরব পঙক্তি।”
আয়রার চোখ চিকচিক করে ওঠে। সে চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর ধীরে বলে,
— “তুমি কি জানো, আমি তোমায় কখন ভালোবেসেছি?”
রাফি একটু অবাক হয়ে তাকায়।
— “না। কখন?”
— “যখন তুমি আমাকে প্রশ্ন করনি। শুধু অপেক্ষা করেছো। ভালোবাসা মানেই হয়তো সে—শব্দ ছাড়া অপেক্ষার নাম।”
---
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। বাইরে বৃষ্টি পড়ে, কিন্তু তারা কাচের পাশে বসে একসাথে কফি চুমুক দেয়। এবার আর মন খারাপের সুর নেই, বরং একধরনের নতুন শুরু।
ক্যাফের ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজে এক পুরনো গানের সুর—
“তুমি আসবে বলেই, আমি বসে আছি…”
এই গল্পের কোনো গন্তব্য নেই, কেবল চলা আছে। আর প্রতিটা চলা হয়তো একেকটা অধ্যায়, যার শেষে লেখা থাকবে—
“জীবন কফির মতো—উষ্ণ, কখনও কড়া, কখনও মিষ্টি। কিন্তু একাকী নয়, যদি পাশে কেউ থাকে।”
শেষ নয়।
শুধু নতুন শুরু।
#চলিত