লোকদেখানো অভিমানের পর সরকার আজ বিবৃতি দিল এবং বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি -এই বড় তিন দলের সাথে বৈঠকও করল। কিন্তু এসব বৈঠকের কোনো ফল জনগণের পক্ষে আসবে এমন সিন্ড্রোম পরিলক্ষিত হলো না। নির্বাচনের যে ট্রেন যাত্রা শুরু করেছে বলা হয়েছে, সেই ট্রেনের প্রকৃত গন্তব্যও এখনো অজানা রয়ে গেল।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ আজ যে বিবৃতি দিয়েছে, তাতে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা, ক্ষমতার ভারসাম্য এবং ভবিষ্যতের রূপরেখা নিয়ে একদিকে যেমন একটি অস্পষ্ট বার্তা দেওয়া হয়েছে, অন্যদিকে তেমনই কিছু স্পষ্ট সংকেতও রেখে দেওয়া হয়েছে, যা উপেক্ষা করার উপায় নেই।
বিবৃতিতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে -নির্বাচন, বিচার ও সংস্কার -এই তিনটি প্রধান দায়িত্বের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, এবং তারা “শত বাধার মাঝেও গোষ্ঠীস্বার্থকে উপেক্ষা করে” কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু ঠিক এই জায়গাটিতেই প্রশ্ন ওঠে -কারা এই বাধা তৈরি করছে? কাদের গোষ্ঠীস্বার্থের কথা বলা হচ্ছে?
উপদেষ্টা পরিষদের ভাষ্য অনুযায়ী, "পরাজিত শক্তি" ও "বিদেশি ষড়যন্ত্র" এখন সরকারের পথে প্রধান অন্তরায়। কিন্তু এই শব্দদ্বয়ের ভেতর যাদের বোঝানো হয়েছে -তাদের নাম উচ্চারণে পরিষদ বরাবরের মতোই সতর্ক ও পরোক্ষ থেকেছে। তবে রাজনৈতিক বাস্তবতায় অভ্যস্ত পাঠকের পক্ষে বুঝতে কষ্ট হয় না, এখানে ইঙ্গিত করা হয়েছে মূলত আওয়ামী লীগ এবং তাদের আন্তর্জাতিক মিত্র, বিশেষ করে ভারতকে।
এই কৌশল নতুন নয় -বাংলাদেশের প্রতিটি শাসনব্যবস্থায় ছায়াশত্রু সৃষ্টি করে নিজের দায় এড়ানোর এই প্রথা প্রবহমান। শাসকের ভাষ্য অনুযায়ী, শত্রু সবসময় বাইরে, নিজের ভেতরের বিভ্রান্তি বা সীমাবদ্ধতার কোনো দায় নেই।
বিবৃতির শেষাংশে বলা হয়েছে, “সরকার জনগণকে সঙ্গে নিয়ে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।” এই বাক্যটিই বিবৃতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং সম্ভবত সবচেয়ে আশঙ্কাজনক ইঙ্গিত। কারণ “জনগণকে সঙ্গে নিয়ে” কথাটির আড়ালে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বহুবার দমন-পীড়নের চূড়ান্ত পর্ব শুরু হয়েছে। কখনও তা জরুরি অবস্থার নামে, কখনও তা গণসমর্থনের নাটক সাজিয়ে। বিবৃতিতে জনগণের প্রত্যাশার কথা থাকলেও নেই কোনো নির্দিষ্ট টাইমলাইন, নেই নির্বাচনের তারিখ বা একটি অংশগ্রহণমূলক রোডম্যাপ।
উপদেষ্টা পরিষদ বলছে, তারা "জুলাই অভ্যুত্থানের জনপ্রত্যাশা" ধারণ করছে। কিন্তু এই জনপ্রত্যাশা কী? জনগণ কি আরেকটি অনির্বাচিত, অগণতান্ত্রিক, পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রিত সরকারের প্রত্যাশা করেছিল? নাকি তারা চেয়েছিল সত্যিকারের গণতন্ত্র, যেখানে ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচন হবে?
এখানে স্পষ্ট দ্বন্দ্ব রয়েছে -একদিকে নির্বাচনের কথা বলা হচ্ছে, অন্যদিকে সেই নির্বাচনের ভবিষ্যৎ ঝুলিয়ে রাখা হচ্ছে এক ধরনের প্রতিপক্ষসৃষ্ট সংকটের উপর। এই দোদুল্যমানতা রাজনৈতিক দায় এড়ানোর চেয়ে বেশি কিছু নয়।
সবমিলিয়ে উপদেষ্টা পরিষদের বিবৃতিটি একদিকে নির্বাচন আয়োজনের সংকল্প প্রকাশ করছে, অপরদিকে ব্যর্থতার দায় অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে সম্ভাব্য কঠোর পদক্ষেপের প্রস্তুতিও জানিয়ে দিচ্ছে।
এই বিবৃতি শাসকের নয় -এটি একজন অভিভাবক শাসকের কণ্ঠস্বর, যিনি মনে করেন, তিনি দেশের চেয়ে বড়, আর দেশের ভবিষ্যৎ শুধু তারই হাতে নিরাপদ।
নিজেদের এতটুকু ভুল দেখতে না পাওয়া বিবৃতিটি যতই আবেগমথিত হোক, তা যদি জনগণের মূল প্রশ্ন -নির্বাচন কবে, কীভাবে ও কার অংশগ্রহণে হবে -তার উত্তর না দেয়, তবে সেটি কেবল কৌশলগত ভাষার খেলাই থেকে যাবে। শাসকের পক্ষে দাঁড়িয়ে জনতাকে বোঝাতে চাইলে, আগে দরকার জনগণের মুখোমুখি হওয়ার সাহস। না হলে জনগণও একদিন এই অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে একই প্রশ্ন ছুঁড়ে দেবে -'আপনারা কী করছিলেন, আমরাও বলে দেব।'
লেখক: সাংবাদিক
২৪ মে ২০২৪