অপয়া মেয়ে চাঁদন
ওমর ফারুক
চাঁদনী—একটি নাম, যা উচ্চারণমাত্রই অনেকের মুখে বিরক্তির রেখা ফুটে ওঠে। গ্রামটির লোকেরা বিশ্বাস করে, তার জন্মই ছিল অমঙ্গলের বার্তা। সে জন্মেছিল এক অশুভ রাতে, যেদিন বজ্রপাতে গ্রামের তিনটি গরু মারা যায়, তার বাবার চাকরির শেষ ঘণ্টা বাজে, আর মাতৃহীন হয়ে যায় একটি শিশু। সেদিন থেকেই চাঁদনী হয়ে ওঠে একটি ভয়ঙ্কর প্রতীক—"অপয়া"।
চাঁদনী বড় হতে থাকে সমাজের ঘৃণার দেয়ালে বন্দি হয়ে। তার দিকে কেউ ভালো চোখে তাকায় না। রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে মানুষ মুখ ঘুরিয়ে নেয়। মন্দিরে বা মসজিদের আশেপাশে তাকে দেখা গেলে যেন পূণ্য নষ্ট হয়ে যাবে—এমন ভয়ে লোকেরা চিৎকার করে উঠত, “ওরে, চাঁদনী আসছে! দূরে যা, দূর!”। তার ছোঁয়া যেন সর্বনাশ ডেকে আনে—এমনই কুসংস্কারে পাগলপ্রায় এই সমাজ।
স্কুলেও তার দিন ছিল দুর্বিষহ। শিক্ষকেরা তাকে অপারগভাবে সহ্য করত, আর সহপাঠীরা যেন এক অদৃশ্য দেয়াল তুলে রাখত তার চারপাশে। কেউ কখনো তার পাশে বসত না, কেউ এক বোতল পানি দিত না, কেউ তার নাম নিতে চাইত না। পরীক্ষায় ভালো ফল করলেও সবাই বলত, “অবশ্যই কিছু না কিছু খারাপ ঘটবে, ও ভালো করল মানেই অশুভ কিছু আসছে।”
চাঁদনীর পরিবারও ছিল গর্বিত নয়, বরং লজ্জিত। মা প্রায়ই বলতেন, “হায় আল্লাহ, কেন যে তোকে জন্ম দিলাম!” বাবা মুখ ফিরিয়ে থাকতেন দিনের পর দিন। আত্মীয়রা এড়িয়ে চলত, যেন সে এক অভিশাপ। কোনো পাত্র পক্ষ তাকে বউ হিসেবে চায়নি, কারণ একটাই—সে নাকি দুর্ভাগ্য নিয়ে আসে।
এমনকি কেউ মারা গেলে, কেউ অসুস্থ হলে, ব্যবসা লস করলেও চাঁদনীর নাম উঠে আসত। “চাঁদনীকে গতকাল দেখেছিলাম,”—এই এক বাক্যে সমস্ত ব্যর্থতার ব্যাখ্যা তৈরি হয়ে যেত।
কিন্তু, বাস্তবে কি সে দোষী? কি এমন অপরাধ ছিল তার? সমাজ এ প্রশ্ন কখনো করে না। তারা খুঁজে নিয়েছে এক বলির পাঁঠা, এক 'অপয়া মেয়ে', যার ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া যায় সকল ব্যর্থতার বোঝা। চাঁদনী যেন সমাজের সকল কালো অধ্যায়ের একটি সহজ ব্যাখ্যা।
চাঁদনী আজও বেঁচে আছে, তবে সে কোনো জীবন্ত মানুষ নয়, সে এক অবহেলিত অস্তিত্ব—সমাজের ঘৃণার প্রতীক। তার গল্প একটুও রূপকথার মতো নয়; বরং এটি বাস্তবের নিষ্ঠুর দলিল।
এ প্রবন্ধে চাঁদনীর গল্প উঠে এসেছে কেবল এক উদ্দেশ্যে—এই ঘৃণার সংস্কৃতি ভেঙে ফেলার জন্য নয়, বরং সমাজের অন্ধ দৃষ্টিভঙ্গির নগ্ন প্রতিচ্ছবি তুলে ধরার জন্য। যেন আমরা বুঝতে পারি, কতটা নির্মম হতে পারে মানুষের তৈরি করা 'অপয়া' তকমা।