আজকের বাংলাদেশে যদি কোনো বাবা তাঁর সন্তানের নাম রাখেন কৃষ্ণ মুহাম্মদ, তবে তার পরিণতি কল্পনা করতেও শিউরে উঠতে হয়। অথচ আজ থেকে একশ বছর আগেই সেই অসাধারণ সাহসিকতা দেখিয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। শুধু নামই রাখেননি, নামের মধ্য দিয়ে সমাজকে জানিয়েছিলেন এক অসাম্প্রদায়িক চেতনার সাহসী বার্তা -ধর্ম নয়, মানুষই মূল।
নজরুলের চার পুত্রের নাম -কৃষ্ণ মুহাম্মদ, অরিন্দম খালেদ (বুলবুল), কাজী সব্যসাচী ও কাজী অনিরুদ্ধ -ছিল ধর্মীয় সংকীর্ণতার গন্ডি ভেঙে বেরিয়ে আসার এক মহত্তম প্রয়াস। এই নামগুলো কোনো কাব্যিক অলঙ্কার নয়, বরং নজরুলের আত্মিক বিশ্বাসেরই নামান্তর।
তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নেই। তাই তাঁর কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল:
“তব মসজিদ-মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবি,
মোল্লা-পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবি!”
তিনি যখন প্রশ্ন তোলেন:
“খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়, কে দেয় সেখানে তালা?” তখন তাঁর কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠে সমস্ত নির্যাতিত, বঞ্চিত মানুষের ব্যথার প্রতিধ্বনি। ধর্মের নামে যারা বিভাজন ঘটায়, ধর্মগ্রন্থকে ব্যবহার করে মানুষকে নিপীড়ন করে, তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েই তিনি উচ্চারণ করেন:
“ও মুখ হইতে কেতাব-গ্রন্থ নাও জোর ক’রে কেড়ে,
যাহারা আনিল গ্রন্থ-কেতাব সেই মানুষেরে মেরে,
পূজিছে গ্রন্থ ভন্ডের দল! মূর্খরা সব শোনো—
মানুষ এনেছে গ্রন্থ;
গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো!”
নজরুলকে শুধু বিদ্রোহের প্রতীক বললে ভুল হবে। তিনি একই সঙ্গে প্রেমের, বেদনার, করুণার কবি। তাঁর দ্রোহে যেমন বজ্রনিনাদ, তেমনি তাঁর শোকগাথায় আছে শিশিরবিন্দুর কোমলতা।
একবার কলকাতার পুলিশ নজরুলের বাড়িতে 'নিষিদ্ধ বই' খোঁজার জন্য তল্লাশি চালায়। বাড়ি তছনছ হচ্ছে, কবি নির্বিকার। হঠাৎ এক পুরোনো বাক্সের দিকে পুলিশ হাত বাড়ালে, নজরুল ছুটে গিয়ে অনুরোধ করেন, “ওটা খুলবেন না।” তবু পুলিশ বাক্স খুলে ফেলে। ভিতরে দেখা গেল প্রয়াত পুত্র বুলবুলের কাপড়চোপড়, খেলনা সযত্নে গুছিয়ে রাখা। চোখে জল নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন নজরুল। পুলিশও থমকে গিয়েছিল। এই সেই বুলবুল, যাঁর মৃত্যুতে নজরুল লিখেছিলেন:
“ঘুমিয়ে গেছে শ্রান্ত হ’য়ে আমার গানের বুলবুলি
করুণ চোখে চেয়ে আছে সাঁঝের ঝরা ফুলগুলি।”
একজন মানুষ, যিনি পুত্রশোকে দুই দিন অনাহারে থেকেও সাঁঝের আলোয় লিখতে বসেন, তিনি নিছক কবি নন, তিনি বাংলা সাহিত্য, সমাজ ও চেতনার এক অবিস্মরণীয় সংবেদন।
নজরুল ছিলেন মুসলমান, প্রমীলা হিন্দু -সময়টা ১৯২২ থেকে ১৯২৪। তখন এই সম্পর্ককে ঘিরে সামাজিক প্রতিবন্ধকতা অস্বাভাবিক ছিল না। তবে আশ্চর্যের বিষয়, মুসলিম সমাজ থেকে বিরোধ আসেনি; বাধা এসেছিল হিন্দু সমাজ থেকে। বয়স ১৮ বছর পার না হওয়ায় 'আহলে কিতাবে'র নিয়ম মেনে নজরুল-প্রমীলার বিয়ে হয়। দুজনেই নিজ ধর্মে অটল থাকলেও সেটি তাদের সুন্দর সহাবস্থানে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।
তৎকালীন কুমিল্লা ছিল ত্রিপুরা রাজ্যের অংশ। ত্রিপুরা রাজ্যের নায়েব বসন্তকুমার সেনগুপ্ত ও তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী গিরিবালা দেবীর একমাত্র সন্তান ছিলেন প্রমীলা সেনগুপ্ত। জন্মের পর তাঁর নাম রাখা হয় প্রমীলা সেনগুপ্ত, আর বিবাহের পর নাম হয় আশালতা। তবে স্বাক্ষরে তিনি সবসময় ‘প্রমীলা নজরুল ইসলাম’ নামই ব্যবহার করেছেন।
'সওগাত’ পত্রিকার ভাদ্র ১৩৩৬ সংখ্যায় ‘শঙ্কিতা’ ছদ্মনামে কবিতা লিখে সেখানে নিজেকে উল্লেখ করেছেন ‘মিসেস্ কাজী নজরুল ইসলাম’ নামে।
প্রমীলার ডাকনাম ছিল দোলনা দেবী। ঘনিষ্ঠজনেরা কখনও ‘দোলন’, কখনও ‘দুলী’ নামে ডাকতেন। সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের মতে, প্রিয়তমার এই নাম স্মরণে রেখে নজরুল তাঁর কাব্যগ্রন্থের নাম রেখেছিলেন দোলনচাঁপা। ‘খুকি ও কাঠবিড়ালী’ কবিতায় প্রমীলাকে তিনি সম্বোধন করেছেন ‘রাঙা দিদি’ নামে।
জীবনের একপর্যায়ে নজরুল এক বিরল অসুস্থতায় শিশুসুলভ সরলতায় ফিরে যান। সে সময় থেকে নিজের মৃত্যুর দিন পর্যন্ত প্রমীলা কবিকে ভালোবাসা আর স্নেহে আগলে রেখেছিলেন নিঃশব্দ ছায়ার মতো।
আমরা আজ সভ্যতার নামে প্রযুক্তিতে এগিয়েছি, কিন্তু মানবিকতায় কতটা এগিয়েছি? যে কবি একশ বছর আগে অসাম্প্রদায়িকতা, সাম্য আর মানবতার গান গেয়েছেন, আজ তাঁর উত্তরসূরিরা কী গাইছে? ধর্মের নামে হত্যা, মতের নামে বিদ্বেষ, জাত-ধর্ম-গোত্রে বিভক্তির বিভীষিকাই কি আজ আমাদের মুখ্য পরিচয়?
আমরা কবিকে শ্রদ্ধা জানাই, তাঁর জন্মদিনে শ্রদ্ধার মালা অর্পণ করি। কিন্তু তাঁর দর্শন, তাঁর “মানুষ” ভাবনার বীজ কী আমরা লালন করি? বরং ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, কূপমন্ডুকতা, হীনমন্যতা আর রাজনৈতিক সুবিধাবাদিতাই আজ নজরুলের চেতনার সবচেয়ে বড় পরিহাস।
তবু, এই আঁধারে কবিই অবারিত আলো।
১৯২২ সালের ১১ আগষ্ট কলকাতা থেকে নজরুলের পরিচালনায় প্রকাশিত হয় অর্ধ-সাপ্তাহিক 'ধুমকেতু'। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ধুমকেতর আর্শীবাণীতে লিখেন:
"কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু ,
আয় চলে আয়, রে ধুমকেত
আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু
দুর্দিনের এই দুর্গশিরে
উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন!
অলক্ষণের তিলক রেখা
রাতের ভালে হোক না লেখা,
জাগিয়ে দেরে চমক মেরে'
আছে য়ারা অর্ধ চেতন!
২৪ শে শ্রাবণ ১৩২৯
শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর"
আমাদের মনুষ্য চেতনারে জাগিয়ে রেখেছে যে নজরুল, তার খবর আমরা ক'জনা রাখি? কবির 'মানুষ' দর্শনের স্বরূপ না জানলে আপনাকে আর জানা হবে না বিশদভাবে।
বন্দনা করি কবি নজরুল।
লেখক: সাংবাদিক
১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ | ২৫ মে ২০২৫