Posts

গল্প

পুরনো ট্রাঙ্কের ভেতরের পৃথিবী

May 25, 2025

গল্প লিখন

54
View


পুরনো ট্রাঙ্কের ভেতরের পৃথিবী
রূপা তখন আট বছরের ছোট্ট মেয়ে। শহর থেকে দূরে, তার দিদার পুরনো দালানে গ্রীষ্মের ছুটি কাটাতে এসেছে। দিদার বাড়িটা ছিল এক রহস্যপুরী। উঁচু উঁচু দেয়াল, ঝুরঝুরে বারান্দা আর বিশাল উঠোন, যেখানে পুরনো আম গাছের নিচে বসে দিদা গল্প বলতেন। কিন্তু রূপার কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল দিদার ঘরের কোণে রাখা, কাঠের পুরনো এক ট্রাঙ্ক।
ট্রাঙ্কটা ছিল বিশাল, প্রায় রূপার সমান। তার ওপরে খোদাই করা ছিল অদ্ভুত সব নকশা, আর একটা মরচে পড়া তালা ঝুলে ছিল তাতে। রূপা যখনই ট্রাঙ্কটা খোলার কথা বলত, দিদা হাসতেন আর বলতেন, "ওটা একটা জাদু ট্রাঙ্ক রে মা, ওতে পুরনো দিনের গল্প থাকে।"
রূপার কৌতূহল আরও বেড়ে যেত। এক দুপুরে, দিদা যখন তার দুপুরের ঘুম দিচ্ছিলেন, রূপা চুপি চুপি দিদার ঘরে ঢুকল। ট্রাঙ্কের কাছে গিয়ে দেখল, তালাটা খোলাই আছে! সম্ভবত দিদা ভুলে খুলে রেখেছিলেন। রূপার ছোট্ট বুকটা ধুকপুক করে উঠল। সে ধীরে ধীরে ট্রাঙ্কের ঢাকনাটা খুলল।
ভেতরে ছিল এক বিস্ময়কর জগৎ! প্রথমে চোখে পড়ল কিছু পুরনো শাড়ি, যেগুলো এখনকার মতো ঝলমলে ছিল না, কিন্তু তাদের রঙে ছিল এক শান্ত আভিজাত্য। তারপর পেল একটা রঙ-বেরঙের সুতার গোলক, যার সাথে জড়িয়ে ছিল একটা অর্ধসমাপ্ত নকশিকাঁথা। কাঁথার প্রতিটি ফোঁড়ে যেন দিদার হাতের স্পর্শ লেগে ছিল।
রূপা আরও ঘাঁটাঘাঁটি করতে লাগল। পেল একটা জীর্ণ অ্যালবাম, তাতে সাদা-কালো ছবি। ছবিগুলোতে অচেনা সব মুখ, কিছু চেনা মুখও আছে – দিদার তরুণ বেলার ছবি, তার বাবা-মায়ের ছোটবেলার ছবি। প্রতিটি ছবিতে লুকিয়ে ছিল এক-একটা গল্প, যা রূপা শুধু কল্পনা করতে পারত।
তারপরে পেল একটা পুরনো ডায়েরি। পাতাগুলো হলুদ হয়ে গেছে, অক্ষরগুলো অস্পষ্ট প্রায়। দিদা এই ডায়েরিতে তার মনের কথা লিখতেন, তার ছোটবেলার স্মৃতি, হাসি-কান্না, স্বপ্ন আর কল্পনার জগৎ। রূপা বুঝতে পারছিল না সবটা, কিন্তু পাতা উল্টে যেতেই তার মনে হলো, সে যেন দিদার জীবনের ভেতর দিয়ে হেঁটে চলেছে।
সবশেষে, ট্রাঙ্কের এক কোণে পেল একটা ছোট কাঠের পুতুল। পুতুলটার এক চোখ ভাঙা, কাপড়গুলো বিবর্ণ। কিন্তু রূপা পুতুলটাকে হাতে নিতেই এক অদ্ভুত অনুভূতি হলো। দিদার ছোটবেলায় হয়তো এই পুতুলটাই ছিল তার সবচেয়ে প্রিয় খেলার সাথী।
সন্ধ্যায় দিদা যখন ঘুম থেকে উঠলেন, রূপা ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল। "দিদা, তোমার জাদু ট্রাঙ্কটা! ওটা তো গল্পের বইয়ের মতো!"
দিদা হাসলেন, "আমি জানতাম তুই একদিন খুলবি। হ্যাঁ রে মা, ওটা আমার পুরনো দিনের গল্প। আমার জীবনের প্রতিটা স্মৃতির টুকরো ওতে রাখা আছে।"
সেই দিন থেকে, রূপা আর শুধু ট্রাঙ্কের ভেতরের জিনিস দেখত না। সে দিদার কাছে বসে পুরনো শাড়িগুলোর গল্প শুনত – কোন অনুষ্ঠানে কোনটা পরা হয়েছিল। ডায়েরির কিছু লেখা দিদা নিজেই পড়ে শোনাতেন, যা ছিল তার কৈশোরের প্রেম আর স্বপ্ন। আর সেই কাঠের পুতুলটা, দিদা বলতেন, সেটা নাকি তাকে অনেক কঠিন সময়ে সাহস জুগিয়েছিল।
ট্রাঙ্কটা শুধু একটা বাক্স ছিল না, ছিল দিদার জীবনের আয়না। আর রূপা, সেই আয়নার ভেতর দিয়ে দিদার ফেলে আসা পৃথিবীটাকে নতুন করে দেখতে পেল। সে বুঝল, পুরনো জিনিসের মধ্যেও লুকিয়ে থাকে অমূল্য সব স্মৃতি আর গল্প, যা নতুন প্রজন্মকে শিখিয়ে যায় জীবনের মানে।
গল্পটি কেমন লাগল?
 

Comments

    Please login to post comment. Login