Posts

ভ্রমণ

আকাশপথের অভিজ্ঞতা

May 26, 2025

Atik

230
View

আকাশপথের অভিজ্ঞতা

লেখক: আব্দুল্লাহ আল আতিক

ঢাকা থেকে কলকাতা। মাত্র ৪৫ মিনিটের যাত্রা, তবুও শিহরণ জাগানো এক অভিজ্ঞতা হয়েছিল আমার জীবনে। জীবনে প্রথমবার বিমানে চড়ার অনুভূতিটাই ছিল ভিন্নরকম, এক অনির্বচনীয় রোমাঞ্চ।

আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। একটি সাহিত্য প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পেয়েছিলাম—প্রথম পুরস্কার! পুরস্কার হিসেবে পেয়ে গেলাম কলকাতায় আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসবে যোগ দেওয়ার সুযোগ। সঙ্গে থাকা–আবাসনের সব ব্যবস্থা আয়োজকদের তরফ থেকে। আর সবচেয়ে বড় কথা—ঢাকা থেকে কলকাতার জন্য বিমান টিকিট। আমি আগে কখনো বিমান যাত্রা করিনি। তাই আনন্দের সঙ্গে ভয়ও কাজ করছিল মনে।

যাত্রার দিন খুব সকালেই হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছে গেলাম বাবা-মার সঙ্গে। ভেতরে ঢুকে বোর্ডিং পাস নেওয়া, ইমিগ্রেশন, সিকিউরিটি—সব কিছুই আমার কাছে নতুন। কাঁচুমাচু মুখে সারাক্ষণ বাবার নির্দেশ মতো চলছিলাম। এক সময় আমি বিমানে ওঠার গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। বাবা বললেন, “ভয় পাস না, জানালার ধারে বসলে আকাশ দেখা যাবে।” মা হেসে বললেন, “আর কিছু হলে বিমানের ক্রুদের জানাস, ওরা সাহায্য করবে।”

ফ্লাইট ছিল সকাল ১০টা ১৫ মিনিটে। সময়মতো বোর্ডিং শুরু হলো। আমি জানালার ধারে একটি সিট পেলাম—উচ্ছ্বাস যেন চেপে রাখতে পারছিলাম না। বিমানে বসে মনে হচ্ছিল আমি যেন কোনো সিনেমার দৃশ্যে অংশ নিচ্ছি। একটু পরেই বিমানের দরজা বন্ধ হয়ে গেল, কেবিন ক্রুরা নিরাপত্তা নির্দেশনা দেওয়া শুরু করলেন। আমি এক দৃষ্টিতে সব কিছু দেখছিলাম। কীভাবে সিট বেল্ট বাঁধতে হয়, অক্সিজেন মাস্ক কোথা থেকে নামবে, লাইফ জ্যাকেট কোথায়—সব শেখাচ্ছেন। মনে হচ্ছিল, আমি যেন এক নতুন পৃথিবীতে প্রবেশ করেছি।

বিমান যখন রানওয়ে ধরে গড়াতে শুরু করল, বুকের মধ্যে এক অদ্ভুত ধুকপুকানি শুরু হলো। ধীরে ধীরে গতি বাড়িয়ে একসময় বিশাল গর্জন দিয়ে আকাশে উঠে গেল বিমান। নিচের পৃথিবী দ্রুত ছোট হয়ে আসছিল। চোখের সামনে যেন একটা স্বপ্নের পর্দা উন্মোচিত হচ্ছিল—ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, সব যেন খেলনার মতো লাগছিল।

আকাশের নীলতার মাঝে আমি হারিয়ে গেলাম। মেঘের ভেলা যেন ছুঁয়ে যাচ্ছে জানালার কাঁচ। সূর্যের আলো বিমানের ডানায় পড়ে ঝিলমিল করছে। সেই মুহূর্তের সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। আমি শুধু বসে বসে দেখছিলাম—নিস্তব্ধ, বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে।

হঠাৎ কানে এল বিমানবালার মিষ্টি কণ্ঠে ঘোষণা, “আমাদের ফ্লাইট এখন ৩০ হাজার ফিট ওপরে। আবহাওয়া অনুকূল রয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা কলকাতায় পৌঁছাব।” সঙ্গে দেওয়া হলো নাস্তা—একটি স্যান্ডউইচ, ফল আর এক কাপ চা। আমি সেগুলো হাতে নিয়েই জানালা দিয়ে মেঘের দেশে হারিয়ে গেলাম আবার।

বিমান যখন কলকাতার আকাশে প্রবেশ করল, নিচে দেখা যাচ্ছিল নদী, শহর আর নানা স্থাপনা। ধীরে ধীরে বিমান নিচে নামতে লাগল। কলকাতার নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু বিমানবন্দরে অবতরণের সময় আমি বুঝতে পারছিলাম, এই ছোট্ট যাত্রাটিও জীবনের একটি বড় অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে।

বিমান থামার পর সবার সঙ্গে আমিও নেমে এলাম। প্রথম পা রাখলাম ভারতের মাটিতে। ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন পরিবেশ, কিন্তু আতিথেয়তায় কোনো খামতি নেই। আয়োজকদের একজন প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন, আমাকে দেখে হাসিমুখে এগিয়ে এলেন। সেদিন সন্ধ্যায় সাহিত্য উৎসব শুরু হলো, বিভিন্ন দেশের কবি-লেখকদের সঙ্গে কথা হলো, নিজের লেখা পাঠ করলাম—সবই অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। কিন্তু আমার মনে সবচেয়ে বেশি দাগ কেটে গেল সেই আকাশযাত্রা।

সেই একবারের অভিজ্ঞতা আমার সাহস বাড়িয়ে দিয়েছিল। এখন আমি দেশে-বিদেশে বহুবার বিমানে চড়েছি, কিন্তু প্রথম যাত্রার মতো অনুভব আর কখনো হয়নি।

সেই ভ্রমণের স্মৃতি আজও চোখে ভাসে—আকাশের নীলে হারিয়ে যাওয়া এক তরুণ, যার চোখে ছিল বিস্ময় আর মনে ছিল রোমাঞ্চ। সেই তরুণ আমি, আজও মনে মনে বলি, “প্রথম বিমানের সেই গল্পটাই ছিল আমার সত্যিকারের উড়ান।

Comments

    Please login to post comment. Login