ভোরের পাখির গান
নিধি প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে ওঠে। কাকডাকা ভোর নয়, তবে যখন ভোরের আলো সবেমাত্র গাছের পাতায় সোনা ছোঁয়াতে শুরু করে, তখনই তার ঘুম ভাঙে। তার ছোট্ট ছাদের বাগানে কিছু গোলাপ আর জুঁই ফুলের গাছ আছে। নিধি প্রতিদিন সকালে সেখানে যায়, গাছের পাতা থেকে শিশিরবিন্দু ঝরতে দেখে, আর ফুলেদের পাপড়ি মেলে দেওয়া দেখে।
কিন্তু নিধির জন্য ভোরের সবচেয়ে সুন্দর অংশটা হলো – পাখির গান। প্রতিদিন একই সময়ে, একই ডাল থেকে একটা চড়ুই পাখি তার গানের সুর তোলে। চড়ুই পাখিটা খুব ছোট, কিন্তু তার গানটা যেন নিধির কানে এক অদ্ভুত প্রশান্তি এনে দেয়। নিধি সেই সুর শুনে মুগ্ধ হয়ে যায়। তার মনে হয়, এই গান যেন প্রতিদিনের নতুন শুরুকে স্বাগত জানাচ্ছে।
নিধি একজন লেখিকা। সে গল্প লেখে। কিন্তু ইদানীং তার লেখার টেবিলে কেমন যেন একটা ক্লান্তি এসে ভর করেছে। শব্দেরা আর তাকে টানছে না, প্লটগুলো আর আকর্ষণীয় লাগছে না। নিজের কাজে সে একটা আনন্দ খুঁজে পাচ্ছিল না। দিনের পর দিন তার ল্যাপটপের সাদা স্ক্রিন তাকে বিদ্রূপ করত।
একদিন, ভোরে ঘুম ভাঙতেই নিধি দেখল, চড়ুই পাখিটা তার usual জায়গা থেকে গান গাইছে না। নিধি একটু অবাক হলো। সে বাগানে গেল, কিন্তু পাখিটাকে কোথাও দেখতে পেল না। তার মনটা খারাপ হয়ে গেল। সারাদিন তার মধ্যে একটা অস্থিরতা কাজ করল। লেখার টেবিলে বসেও সে কোনো শব্দ খুঁজে পেল না।
পরদিন সকালে, নিধি আবার ছাদে গেল। এবারও পাখিটা নেই। দুই দিন, তিন দিন... চড়ুই পাখিটা আর এলো না। নিধির মন ক্রমশ খারাপ হতে থাকল। সে তার ভোরের সঙ্গী পাখিকে খুব মিস করছিল। তার লেখার কাজটা আরও বেশি স্থবির হয়ে গেল।
চতুর্থ দিন সকালে, নিধি ছাদে গিয়ে একটা পরিচিত সুর শুনতে পেল। সেই চড়ুই পাখিটা! কিন্তু এবার সে তাদের ছাদের আম গাছ থেকে নয়, বরং পাশের বাড়ির ছাদের কার্নিশ থেকে গান গাইছে। নিধি হাসল। সে বুঝতে পারল, পাখিটা হয়তো নিজের জন্য একটা নতুন বাসা খুঁজে নিয়েছে, বা হয়তো একটু জায়গা পরিবর্তন করেছে। পাখিটা হয়তো জানে না, তার গান নিধির জীবনে কতটা প্রভাব ফেলে।
পাখিটাকে নতুন জায়গায় গান গাইতে দেখে নিধির মনে এক অদ্ভুত শান্তি ফিরে এলো। সে বুঝল, কখনো কখনো আমরা একঘেয়েমি থেকে মুক্তি পেতে চাই, একটা পরিবর্তনের প্রয়োজন হয়। পাখিটা হয়তো প্রতিদিন একই ডাল থেকে গান গেয়ে একঘেয়ে হয়ে গিয়েছিল, তাই নিজের জন্য একটা নতুন ডাল খুঁজে নিয়েছে।
নিধি সেদিন তার লেখার টেবিলে ফিরে এলো। তার মনে হলো, সেও হয়তো তার লেখার পদ্ধতি বা বিষয়বস্তুতে একটা পরিবর্তন আনতে পারে। সে তার পুরনো লেখালেখির ধারা ভেঙে নতুন কিছু চেষ্টা করল। সে সেই চড়ুই পাখির গান নিয়েই একটা নতুন গল্প লিখতে শুরু করল – একটি পাখি কীভাবে প্রতিদিনের নতুন শুরুকে স্বাগত জানায়, আর সেই গান কীভাবে একজন মানুষের জীবনে নতুন অনুপ্রেরণা নিয়ে আসে।
নিধি বুঝতে পারল, পরিবর্তন মানেই শেষ নয়, বরং নতুন শুরুর ইঙ্গিত। ভোরের পাখির গান তাকে এই মূল্যবান শিক্ষা দিয়েছিল। আর সেই দিনের পর থেকে, নিধি তার লেখায় নতুন প্রাণ খুঁজে পেল, যেমনটি ভোরের পাখি প্রতিদিন নতুন করে গান গেয়ে ওঠে।
54
View