Posts

চিন্তা

চাকরি অধ্যাদেশ ৩৭ক: প্রশাসনিক দাসত্বের ফাঁদ না হোক

May 27, 2025

ফারদিন ফেরদৌস

142
View

সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর বিরুদ্ধে টানা চতুর্থ দিনের মতো সচিবালয়ে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছেন বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মচারীরা। তাঁদের দপ্তর ছেড়ে বিপুলসংখ্যক কর্মচারী এই কর্মসূচিতে অংশ নেন। প্রশাসন ক্যাডার বাদে সিভিল সার্ভিসের ২৫টি ক্যাডার কর্মকর্তাদের সংগঠন ‘আন্তক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ’ আজ থেকে দুই দিনের কলমবিরতিতে যাচ্ছে। অন্যদিকে, ‘এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ’ এনবিআর চেয়ারম্যানের অপসারণ দাবিতে তিন দিনের আলটিমেটাম দিয়েছে।

এ ছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল বিদেশিদের কাছে হস্তান্তরের প্রতিবাদেও আন্দোলন চলছে। সংশোধিত সরকারি চাকরি আইনটিকে সমর্থন করে এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের দৃষ্টিতে এই আইন ইতিবাচক। তাঁর মতে, একযোগে এত আন্দোলন একটি ‘সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ক্যু’র ইঙ্গিতও হতে পারে।

বাংলাদেশে সরকারি চাকরি কি নিঃশর্ত আনুগত্যের শৃঙ্খলে বাঁধা পড়ার নাম? রাষ্ট্রীয় সেবায় নিয়োজিত একজন কর্মচারী কি ব্যক্তিস্বাধীনতা ও নৈতিক বিবেচনার ঊর্ধ্বে শুধুই আদেশ পালনকারী যন্ত্র?

২০১৮ সালের সরকারি কর্মচারী আইন সংশোধন করে সদ্য জারি করা এই অধ্যাদেশে সবচেয়ে বিতর্কিত ধারা -৩৭ক -এ 'আচরণ বা দণ্ড সংক্রান্ত’ বিশেষ বিধানে বলা হয়েছে:
• কেউ যদি এমন কোনো কার্যে লিপ্ত হন, যাহা অনানুগত্যের (Insubordination) শামিল বা যাহা অন্য যেকোনো সরকারি কর্মচারীর মধ্যে অনানুগত্য সৃষ্টি করে বা শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করে বা কর্তব্য সম্পাদনে বাধার সৃষ্টি করে।”

• এককভাবে বা সম্মিলিতভাবে ছুটি ব্যতীত কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকলে। কাউকে কর্মবিরতিতে বাধ্য বা উস্কানি দেওয়া, অন্য কর্মচারীকে কাজে বাধা দেওয়া হলে;

• কোনো কর্মচারীকে তার কর্মস্থলে আসতে বা কাজ করতে বাধা দেওয়া হলে তা দণ্ডনীয় অপরাধ হবে।

এসব অপরাধের শাস্তি হিসেবে পদাবনতি বা গ্রেড অবনতি, চাকরি থেকে অপসারণ কিংবা চাকরি থেকে বরখাস্ত করার বিধান রাখা হয়েছে।

সংশোধিত অধ্যাদেশে ‘অনানুগত্য’ শব্দটি এমন অস্পষ্ট ও ভিন্নতরভাবে সংজ্ঞায়িত যে, কোনো উর্ধ্বতন কর্মকর্তার বেআইনি আদেশ অমান্য করলেও কর্মচারীকে শাস্তি পেতে হতে পারে। অথচ সংবিধানের ২৬ ও ২৭ অনুচ্ছেদ বলছে, সকল নাগরিকের মৌলিক অধিকার ও আইনের দৃষ্টিতে সমতা নিশ্চিত করতে হবে -কর্মচারীদের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য।

রাষ্ট্র ও সরকার এক বিষয় নয়। রাষ্ট্র একটি চিরস্থায়ী কাঠামো -যেখানে জনগণ, ভূখণ্ড, প্রশাসন ও সার্বভৌমত্ব রয়েছে। বিপরীতে, সরকার সময়োপযোগী একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা, যা পরিবর্তনশীল। সেই অর্থে সরকারি কর্মচারীর দায়বদ্ধতা সরকারের প্রতি নয়, বরং সংবিধান ও জনগণের প্রতি।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় -বেআইনি আদেশ পালন করে কেউ দায়মুক্ত হয়নি। যেমন সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন বা ডিবি হারুনসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা চলছে, যাঁরা ‘উর্ধ্বতনের আদেশ’ পালনের যুক্তি দিয়ে দায় এড়াতে পারছেন না।

৩৭ক ধারা যেন সরকারি চাকরিকে আবারও ‘ঔপনিবেশিক দাসত্বে’ ঠেলে দিচ্ছে। এই আইন শুধু শাসন নয়, শোষণের পথও প্রশস্ত করতে পারে -বিশেষত তখন, যখন প্রশাসন ক্যাডার এই আইনকে নিজেদের একচেটিয়া সুবিধার ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।

বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠামোয় দীর্ঘদিন ধরে এক অসম বৈষম্য বিরাজ করছে। প্রশাসন ক্যাডার কার্যত অন্য ২৬টি ক্যাডারের ওপর কর্তৃত্ব করে আসছে। শিক্ষা, কৃষি, স্বাস্থ্য, পরিবেশ, আইন, এমনকি দুর্নীতি দমন কমিশন বা নির্বাচন কমিশনের মতো সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানেও নিজেদের আধিপত্য কায়েম করছে। ‘প্রেষণ’-এর নামে অন্য ক্যাডারের পদও তারা দখল করছে। অথচ এর কোনো সাংবিধানিক বা নৈতিক ভিত্তি নেই।

সরকারি চাকরি দয়া নয় -এটি একটি চুক্তিভিত্তিক দায়িত্ব। সেই চুক্তির শর্ত যদি একতরফাভাবে নির্ধারিত হয়, তবে তা স্বৈরতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার ঝুঁকি তৈরি করে। যদি কর্মচারীদের শুধুই ‘হুকুমের গোলাম’ হতে হয়, তবে গণতন্ত্রের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে।

সংশোধিত আইনটির বিরুদ্ধে যেসব কর্মচারী প্রতিবাদে শামিল হতে রাস্তায় দাঁড়াচ্ছেন তাদের বলা হচ্ছে 'সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ক্যু' -এর অংশীদার। বলছে কে? নব্যগঠিত রাজনৈতিক দল এনসিপি -এখন পর্যন্ত যাদের সরকার পরিচালনা কিংবা সংসদে গিয়ে আইন প্রণয়নের সুযোগ হয়নি।

৩৭ক আইনি ধারা কোনোমতেই যেন প্রশাসনিক দমননীতির প্রতিভু না হয়ে ওঠে। এই ধারা বাতিল না হলেও এমনভাবে সংশোধন জরুরি, যাতে আইনের শাসন, কর্মচারীর পেশাগত মর্যাদা ও নৈতিক অধিকার সংরক্ষিত থাকে। একটি আইন তখনই ন্যায্য হয়, যখন তা রাষ্ট্র ও জনগণের কল্যাণে ব্যবহৃত হয় -কেবল কিছু সুবিধাভোগীর স্বার্থরক্ষায় নয়।

লেখক: সাংবাদিক 
২৭ মে ২০২৫

Comments

    Please login to post comment. Login