"তানসেন: অন্ধকার সমুদ্রের বিভীষিকা"
ভূমিকা:- ২৭ নভেম্বর, ২০২১। ইউরোপের এক কোলাহলপূর্ণ বন্দরনগরী, হামবুর্গ। শীতের হিমেল বাতাস জেটির ধারে বাঁধা জাহাজগুলোর পালের দড়িতে মৃদু গুঞ্জন তুলছে। এই ব্যস্ততার মধ্যেই, তানসেন, দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এক নাবিক, তার নতুন কর্মস্থলের সন্ধানে এসেছিলেন। আজ, এসএস মেরিনো নামক এক বিশাল পণ্যবাহী জাহাজে তিনি একজন গুরুত্বপূর্ণ পদে যোগ দিতে চলেছেন। জাহাজটি সুদূর এশিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করবে। তানসেনের রক্তে সমুদ্রের ঢেউয়ের হাতছানি, নতুন দিগন্তের পিয়াস। কিন্তু এই যাত্রা যে তার জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা হতে চলেছে, সে বিষয়ে তার কোনো ধারণাই ছিল না...
এসএস মেরিনো, একটি পুরনো কিন্তু শক্তিশালী জাহাজ, বন্দরে নোঙর ফেলে অপেক্ষায় ছিল তার নতুন ক্রুদের জন্য। তানসেন জাহাজে উঠে তার কেবিন খুঁজে নিলেন। কেবিনের জানালা দিয়ে বন্দরের ব্যস্ত চিত্র দেখা যাচ্ছিল। কিছুক্ষণ পরেই, জাহাজের ডেকে অন্যান্য ক্রুদের আনাগোনা শুরু হল। নানা দেশ, নানা ভাষার মানুষের এক বিচিত্র সমাহার। তাদের চোখেমুখে ছিল সমুদ্রের অজানাকে জয় করার উত্তেজনা, আবার কোথাও যেন এক চাপা উদ্বেগও লুকিয়ে ছিল।
অধ্যায় ১: যাত্রা শুরু
বিকেল তিনটা নাগাদ জাহাজের ডেকে এক জরুরি সভা ডাকা হল। ক্যাপ্টেন জন, এক বলিষ্ঠ চেহারার প্রৌঢ়, যাঁর চোখে অভিজ্ঞতার গভীর ছাপ স্পষ্ট, গম্ভীর স্বরে সকলের উদ্দেশ্যে কথা বলতে শুরু করলেন। তাঁর কণ্ঠস্বরে কর্তৃত্বের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল। "শুনে রাখো সবাই," তিনি বললেন, "আমরা সিঙ্গাপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করছি। পথ দীর্ঘ এবং বন্ধুর হতে পারে। কিন্তু আমাদের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ আচরণই এই যাত্রাকে সফল করবে। কোনওরকম গাফিলতি আমি বরদাস্ত করব না।" এরপর ক্যাপ্টেন জন একে একে জাহাজের প্রধান কর্মকর্তাদের সঙ্গে সকলের পরিচয় করিয়ে দিলেন। রিজওয়ান, তানসেনের পুরনো বন্ধু, জাহাজের প্রথম অফিসার হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। রিজওয়ানের হাসিমাখা মুখ দেখে তানসেনের মনে কিছুটা স্বস্তি ফিরে এল। মেঘলা, জাহাজের প্রধান ইঞ্জিনিয়ার, শ্যামলা বর্ণের এক রহস্যময়ী নারী, যাঁর চোখে যেন সমুদ্রের গভীরতা লুকানো ছিল। ডোমিংকো, স্প্যানিশ বংশোদ্ভূত স্থূলকায় রাঁধুনি, যাঁর রসনাবিশ্বের খ্যাতি জাহাজে ইতিমধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছিল। ব্রায়ান, একজন ব্রিটিশ নাবিক, যাঁর লালচে মুখ ও টলমলে চাহনি দেখে মনে হচ্ছিল মদ্যপান করাই তাঁর নিত্যদিনের সঙ্গী। ফানানি ফরিদ, দীর্ঘদেহী ও কৃষ্ণকায় কঙ্গোলিজ নাবিক, যাঁর শারীরিক শক্তি সম্পর্কে ইতিমধ্যেই নানা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল। অর্নিকা ও আনিশা, দুই তরুণী বোন, জাহাজের মেডিকেল স্টাফ হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। তাদের মিষ্টি হাসি জাহাজের গুমোট আবহাওয়ায় কিছুটা হলেও স্বস্তি এনেছিল। সবশেষে পরিচয় হল রকির সাথে, ককপিটের তরুণ রেডিও অপারেটর, যার চোখে সবসময় একটা ভয়ের ছাপ লেগে থাকত। ২৭শে নভেম্বরের পড়ন্ত বিকেলে, এসএস মেরিনোর ইঞ্জিনের গর্জন বন্দরের নীরবতা ভঙ্গ করে যাত্রা শুরু করলো। হামবুর্গের তীর ধীরে ধীরে অস্পষ্ট হয়ে মিলিয়ে গেল দিগন্তে। তানসেন রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে বিশাল সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রইলেন। দিগন্তবিস্তৃত জলরাশি, উপরে ধূসর আকাশ – এক অপার্থিব দৃশ্য। কিন্তু তার মনের গভীরে যেন এক অজানা আশঙ্কা দানা বাঁধতে শুরু করলো। এই শান্ত সমুদ্রের গভীরে কী লুকিয়ে আছে, তা হয়তো কেউই জানে না... প্রথম কয়েকদিন সবকিছু স্বাভাবিকভাবেই কাটলো। জাহাজের কর্মীরা তাদের নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত ছিল। ডোমিংকো তার সুস্বাদু রান্না দিয়ে সকলের মন জয় করে নিয়েছিল। রিজওয়ান এবং তানসেন পুরনো দিনের গল্পে মেতে থাকতেন। মেঘলা দিনের বেশিরভাগ সময় ইঞ্জিন রুমেই কাটাতেন। ব্রায়ান প্রায় সবসময়ই নিজের কেবিনে মদ্যপ অবস্থায় পড়ে থাকতেন। ফানানি ফরিদ নীরবে তার কাজ করে যেতেন, তার শক্তিশালী শরীর যেন জাহাজের প্রতিটি কঠিন কাজে সাহায্য করতো। অর্নিকা ও আনিশা জাহাজের অসুস্থ কর্মীদের সেবায় নিয়োজিত থাকতেন। রকি ককপিটে বসে দূরবর্তী বন্দরের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতেন।
অধ্যায় ২: প্রথম আতঙ্ক
৩রা ডিসেম্বর, ২০২১। জাহাজ তখন আরব সাগরের উত্তাল জলরাশিতে দুলছে। রাতের নিস্তব্ধতা হঠাৎই ভেঙে গেল এক অদ্ভুত শব্দে। জাহাজের কার্গো হোল্ডের দিক থেকে চাপা গোঙানির মতো আওয়াজ ভেসে আসতে শুরু করলো। প্রথমে নাবিকরা বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দিল না, ভেবেছিল হয়তো সমুদ্রের ঢেউয়ের ধাক্কায় কার্গোতে থাকা জিনিসপত্রের নড়াচড়ার ফলে এই শব্দ হচ্ছে। কিন্তু শব্দের তীব্রতা ক্রমশ বাড়তে থাকায় তানসেন এবং রিজওয়ান দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন।
তারা দুজনে মিলে টর্চ লাইট হাতে কার্গো হোল্ডের দিকে রওনা হলেন। লোহার সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামতেই একটা ঠান্ডা স্রোত তাদের শরীর ছুঁয়ে গেল। কার্গো হোল্ডের বিশাল জায়গা জুড়ে অসংখ্য পণ্যবাহী বাক্স স্তূপ করে রাখা ছিল। টর্চের আলোয় তারা দেখতে পেলেন, কয়েকটি বাক্স খোলা, আর তাদের চারপাশে জমাট বাঁধা রক্তের কালচে দাগ! কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, সেখানে কোনো মৃতদেহ বা আঘাতের চিহ্ন দেখা গেল না। রক্তের উৎস যেন এক রহস্যের বেড়াজালে ঢাকা।
খবরটি মুহূর্তের মধ্যে জাহাজের সকল কর্মীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়লো। আতঙ্ক আর উদ্বেগে সকলের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। মেঘলা, ঠান্ডা গলায় বললেন, "আমার মনে হচ্ছে, কোনো অশুভ শক্তি আমাদের সাথে খেলছে।" তার কথা শুনে সকলের শিরদাঁড়া দিয়ে যেন হিমস্রোত বয়ে গেল।
সেই রাতেই ঘটলো আরও এক ভয়াবহ ঘটনা। নদী, বছর কুড়ির এক তরুণ ও হাসিখুশি নাবিক, রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়ে গেল। রাতের শিফটে কাজ শেষে সে নিজের কেবিনে ঘুমাতে গিয়েছিল। সকালে যখন অন্যান্য নাবিকরা তাকে ডাকতে যায়, তখন দেখে কেবিনের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে তারা যা দেখলো, তাতে তাদের চোখ কপালে উঠলো। নদীর বিছানা ফাঁকা, কিন্তু ঘরের মেঝেতে ভেজা পায়ের ছাপ স্পষ্ট। যেন কেউ সমুদ্র থেকে উঠে এসে তাকে টেনে নিয়ে গেছে! কিন্তু কে বা কারা এমন কাজ করলো, তার কোনো কূলকিনারা পাওয়া গেল না। জাহাজের শান্ত atmosphere মুহূর্তে এক ভয়াবহ আতঙ্কের কেন্দ্রে পরিণত হলো।
অধ্যায় ৩: অভিশপ্ত দ্বীপ
১৫ই ডিসেম্বর, ২০২১। ভারত মহাসাগরের বুকে তখন এক ভয়ংকর ঝড় আছড়ে পড়েছে। বিশাল ঢেউগুলো জাহাজের ওপর আছড়ে পড়ছে, যেন কোনো দৈত্য তাকে টেনে নীচে নামাতে চাইছে। এসএস মেরিনোর নাবিকরা প্রাণপণে জাহাজটিকে সামলে রাখার চেষ্টা করছে, কিন্তু প্রকৃতির রুদ্রমূর্তির কাছে তাদের সকল প্রচেষ্টা যেন ব্যর্থ হতে চলেছে। ঝড়ের তীব্রতায় জাহাজের নেভিগেশন সিস্টেম সম্পূর্ণ বিকল হয়ে গেল। দিকভ্রান্ত জাহাজটি অবশেষে একটি অচেনা দ্বীপের কাছাকাছি এসে থামতে বাধ্য হলো।
দ্বীপটি ঘন সবুজ গাছপালা আর পাথুরে টিলায় ভরা। স্থানীয় কিংবদন্তী অনুসারে, এই দ্বীপটি অভিশপ্ত, এখানে নাকি অশরীরীদের আনাগোনা লেগেই থাকে। নাবিকদের মধ্যে দ্বীপটি "দ্বীপ X" নামেই পরিচিত ছিল। জাহাজের মেরামতের জন্য এবং জরুরি কিছু রসদ সংগ্রহের জন্য ক্যাপ্টেন জন কয়েকজন নাবিককে দ্বীপে অনুসন্ধানের জন্য পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। সেই দলে ছিলেন তানসেন, রিজওয়ান, ফানানি ফরিদ এবং অর্নিকা।
দ্বীপে নেমে তারা একটি পরিত্যক্ত জনবসতির ধ্বংসাবশেষ দেখতে পেলেন। ভাঙা কুঁড়েঘর, মরচে ধরা তৈজসপত্র আর কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু কঙ্কাল – যেন এক করুণ ইতিহাসের নীরব সাক্ষী। দ্বীপের গভীরে যেতেই তারা আরও ভয়ংকর কিছুর সন্ধান পেলেন। একটি নির্জন সৈকতে তারা একটি পুরনো, পরিত্যক্ত জাহাজ দেখতে পেলেন। জাহাজটির ডেকে একটি কঙ্কাল শিকল দিয়ে বাঁধা ছিল! কঙ্কালটির মুখের বিভৎস হাঁ দেখে মনে হচ্ছিল যেন সে কোনো ভয়ানক যন্ত্রণায় চিৎকার করতে চেয়েছিল। এই বীভৎস দৃশ্য দেখে নাবিকদের রক্ত হিম হয়ে গেল। তারা দ্রুত জাহাজে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু জাহাজে ফিরে এসে তারা আরও ভয়ানক পরিস্থিতির সম্মুখীন হলো। জাহাজের রেডিওতে কে বা কারা যেন একটানা একই বার্তা পাঠাচ্ছে: "ওয়ান অব আস ইজ নট হিউম্যান..." ("আমাদের মধ্যে একজন মানুষ নয়...")। বার বার একই কথা ভেসে আসছে, যেন কোনো অশরীরী আত্মা তাদের সাবধান করছে। রকির মুখ ভয়ে সাদা হয়ে গেল। সে বারবার বলতে লাগলো, "আমি এই মেসেজ পাঠাইনি! আমি কসম করে বলছি!"
অধ্যায় ৪: রক্তপিপাসু সমুদ্র
জানুয়ারি মাস, ২০২২। এসএস মেরিনো তখন মালাক্কা প্রণালীর সংকীর্ণ জলপথ ধরে এগিয়ে চলেছে। ঝড়ের ধাক্কা সামলে উঠলেও জাহাজের কর্মীদের মনে আতঙ্ক তখনও বিরাজ করছে। "আমাদের মধ্যে একজন মানুষ নয়..." – এই বার্তা যেন তাদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। এর মধ্যেই জাহাজে একের পর এক রহস্যজনক মৃত্যু ঘটতে শুরু করলো।
একদিন সকালে, ডেক পরিষ্কার করার সময় একজন নাবিকের নিথর দেহ খুঁজে পাওয়া গেল। তার শরীর বরফের মতো ঠান্ডা, যেন কেউ তার সমস্ত রক্ত শুষে নিয়েছে। পরের দিন, আরেকজন নাবিক তার কেবিনে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেল, তার গলা ধারালো কিছু দিয়ে কাটা। আতঙ্ক ক্রমশ বাড়তে থাকলো, নাবিকরা একে অপরের দিকে সন্দেহের চোখে তাকাতে শুরু করলো।
তানসেনের সন্দেহ গিয়ে পড়লো মেঘলা আর ডোমিংকো-র উপর। মেঘলার রহস্যময় আচরণ আর ডোমিংকো-র চাপা হাসি যেন কোনো গোপন রহস্য বহন করছে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণ তিনি খুঁজে পেলেন না।
এক রাতে, ব্রায়ান মদ্যপ অবস্থায় ডেকে বেরিয়ে এসে পাগলের মতো চিৎকার করতে শুরু করলো: "সেটা জলের নিচে আছে! ও আমাদের দেখছে! ওর চোখ... জ্বলন্ত আগুনের মতো!" পরদিন সকালে ব্রায়ানকেও মৃত অবস্থায় পাওয়া গেল। তার চোখ দুটো উপড়ে নেওয়া হয়েছে...
সমুদ্র যেন রক্তপিপাসু হয়ে উঠেছে। রাতের অন্ধকারে জাহাজের ডেকে রহস্যময় পায়ের শব্দ শোনা যায়। মনে হয় যেন কোনো অশরীরী আত্মা মুক্তভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে, শিকারের সন্ধানে। অর্নিকা আর আনিশা আতঙ্কিত হয়ে তাদের কেবিনে নিজেদের বন্দি করে রাখে। ফানানি ফরিদ সবসময় হাতের কাছে ধারালো ছুরি রাখে, যেকোনো বিপদের মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত থাকে।
অধ্যায় ৫: শেষ সংঘাত
১৫ই সেপ্টেম্বর, ২০২২। দীর্ঘ আর ভয়াবহ একটি বছর পার করে এসএস মেরিনো অবশেষে সিঙ্গাপুরের কাছাকাছি এসে পৌঁছেছে। কিন্তু এই দীর্ঘ যাত্রায় জাহাজের অনেক নাবিক প্রাণ হারিয়েছে। এখন বেঁচে আছে মাত্র পাঁচজন – তানসেন, মেঘলা, ডোমিংকো, ফানানি ফরিদ এবং রকি।
এক রাতে, যখন আকাশ কালো মেঘে ঢাকা আর সমুদ্র উত্তাল, তানসেন হঠাৎ করেই জাহাজের পুরনো লগবুকটি খুঁজে পান। সেই লগবুকে লেখা ছিল এসএস মেরিনোর এক ভয়াবহ অতীতের কথা। পঞ্চাশ বছর আগে, এই জাহাজটিই এক ভয়ংকর দুর্ঘটনায় ডুবে গিয়েছিল, আর সেই দুর্ঘটনায় জাহাজের সকল যাত্রী ও কর্মী মারা গিয়েছিল। স্থানীয়দের বিশ্বাস, সেই মৃত আত্মারা এখনও এই জাহাজে ঘুরে বেড়ায়, নতুন শিকারের সন্ধানে।
তানসেন বুঝতে পারলেন, সেই "ওয়ান অব আস ইজ নট হিউম্যান" বার্তাটির আসল অর্থ। কোনো জীবিত মানুষ নয়, বরং মৃত আত্মারা ভর করেছে এই জাহাজে। আর তারাই ধীরে ধীরে কেড়ে নিচ্ছে তাদের জীবন।
ঠিক সেই মুহূর্তে, মেঘলার চোখ অস্বাভাবিকভাবে লাল হয়ে ওঠে। তার কণ্ঠস্বর পাল্টে যায়, এক শীতল, অমানবিক স্বরে সে বলে, "তোমরা আমাদের থেকে পালাতে পারবে না।" ডোমিংকোও তার স্থূলকায় শরীর নিয়ে অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায় তানসেনের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
এক ভয়াবহ সংঘাত শুরু হয়। ফানানি ফরিদ তার সমস্ত শক্তি দিয়ে মেঘলা আর ডোমিংকোকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু অশরীরী শক্তির কাছে সে অসহায় হয়ে পড়ে। মেঘলা আর ডোমিংকো যেন মানুষ নয়, সাক্ষাৎ নরকের দূত। রিজওয়ান এবং অর্নিকা শেষ পর্যন্ত তাদের রক্ষা করতে গিয়ে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে।
শেষ পর্যন্ত তানসেন একা দাঁড়িয়ে থাকে। তার হাতে একটি ধারালো কুড়াল, আর চোখে প্রতিশোধের আগুন। মেঘলা আর ডোমিংকো ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে আসে। এক শ্বাসরুদ্ধকর লড়াইয়ের পর তানসেন তাদের দুজনকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়, কিন্তু তাদের শরীর যেন মুহূর্তে ধুলোয় মিশে যায়।
ধ্বংসস্তূপের মধ্যে একা দাঁড়িয়ে তানসেন বুঝতে পারে, এই লড়াই শেষ হয়নি। জাহাজের অন্যান্য মৃত আত্মারা এখনও আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাঁচার আর কোনো আশা নেই জেনেও, সে শেষ চেষ্টা করার সিদ্ধান্ত নেয়। একটি লাইফবোটে কিছু জরুরি সরঞ্জাম আর খাবার নিয়ে সে ঝাঁপ দেয় উত্তাল সমুদ্রে। পিছনে ধীরে ধীরে অন্ধকারে ডুবে যায় এসএস মেরিনো – এক অভিশপ্ত জাহাজ, যার বুকে লেখা রয়েছে এক ভয়াবহ সমুদ্রযাত্রার করুণ ইতিহাস।
তানসেন লাইফবোটে ভেসে বেড়াতে থাকে, ক্লান্ত আর বিধ্বস্ত। মাথার উপর অনন্ত আকাশ, নীচে অথৈ সমুদ্র। তার মনে একটাই প্রশ্ন – সমুদ্র কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে? উত্তর হয়তো তার জানা নেই, কিন্তু সেই রাতের ভয়াবহ স্মৃতি কোনোদিনও তার মন থেকে মুছে যাবে না। কেউ জানে না, এই অন্ধকার সমুদ্র আর কত ভয়ঙ্কর রহস্য লুকিয়ে রেখেছে তার গভীরে...