Posts

গল্প

* মাহিনের প্রবাস যাত্রা

May 28, 2025

Abiyan Khan

85
View

মাহিনের প্রবাস যাত্রা: জন্ম থেকে মৃত্যু
সেদিন ছিল ভরা বর্ষার এক বিষণ্ণ সন্ধ্যা। বাংলাদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রামে মাহিনের জন্ম হয়েছিল। অভাবের সংসারে নতুন মুখের আগমন আনন্দের বদলে নিয়ে এসেছিল আরও চিন্তার ভাঁজ। বাবা রিকশা চালাতেন, মা গৃহস্থালির কাজ সামলাতেন। ছোটবেলা থেকেই মাহিন বুঝত, তাদের স্বপ্নগুলো গ্রামের কাদামাটির পথেই আটকে আছে। তার চোখে ছিল অন্য স্বপ্ন – এক ঝলমলে জীবনের, যেখানে অভাবের ছায়া পড়বে না।
স্কুল পেরিয়ে কলেজে পা রাখতে না রাখতেই মাহিনের মনে প্রবাসের বীজ বুনেছিল তার পাশের বাড়ির এক ফেরা প্রবাসী। চকচকে জামাকাপড়, হাতে দামি ঘড়ি, আর মুখে বিত্তের গল্প শুনে মাহিন ঠিক করে ফেলে, তাকেও বিদেশে যেতে হবে। দিনরাত এক করে সে কাজ শুরু করল। কখনও কৃষি জমিতে মজুরি, কখনও বা শহরে গিয়ে দিনমজুরের কাজ। মায়ের হাতের বালা, বোনের কানের দুল – সব বিক্রি করে দালালের হাতে তুলে দেওয়া হলো। পনেরো বছর বয়সেই মাহিন উড়াল দিল মধ্যপ্রাচ্যের এক অজানা দেশে, বুকভরা স্বপ্ন আর চোখে রাজ্যের অনিশ্চয়তা নিয়ে।
প্রথম ক’বছর কেটেছিল হাড়ভাঙা পরিশ্রমে। মরুভূমির তপ্ত বালিতে তার তারুণ্য মিশে যেতে শুরু করেছিল। নির্মাণাধীন ভবনের রড সিমেন্টের ভিড়ে তার পরিচয় হয়ে গেল কেবল একজন শ্রমিক। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ, মাথার উপর তীব্র সূর্য, আর রাতের বেলা নোংরা ডরমিটরিতে ঘুম। দিনের শেষে হাতে আসত সামান্য কিছু টাকা, যার বেশিরভাগই দেশে পাঠাতে হতো। বাবা-মায়ের চিকিৎসার খরচ, ছোট ভাইবোনের পড়াশোনা, বোনের বিয়ের জন্য জমানো টাকা – সবকিছুর দায়ভার তখন তার কাঁধে। ঈদ বা পূজায় দেশের জন্য মন কেমন করত, কিন্তু ছুটি পাওয়া ছিল দুঃস্বপ্ন। ভিডিও কলে স্বজনদের হাসিমুখ দেখেই সে নিজেকে সান্ত্বনা দিত।
আট বছর পর মাহিনের ভাগ্য একটু বদলালো। সে একটি ছোট ঠিকাদারি কাজ পেল। ধীরে ধীরে তার সততা আর পরিশ্রমের কারণে তার পরিচিতি বাড়তে লাগল। নিজের একটি ছোট ব্যবসা শুরু করল, কয়েকজন বাংলাদেশি শ্রমিককে কাজ দিল। এই প্রথম সে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। দেশে একটি পাকা বাড়ি তৈরি করল, বাবার রিকশা চালানো বন্ধ হলো, ভাইবোনদের পড়াশোনা শেষ হলো। মনে মনে শান্তি পেত এই ভেবে যে, তার কষ্টের ফল অন্যেরা ভোগ করছে।
কিন্তু প্রবাস জীবনের একাকীত্ব তাকে ভেতরে ভেতরে কুরে কুরে খাচ্ছিল। নিজের জন্য সে কিছুই করেনি। ভালোবাসার জন্য সময় ছিল না, বিয়েও করা হয়নি। কর্মব্যস্ততার কারণে একাকীত্বটা যেন আরও প্রকট হয়ে উঠত। দেশের বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ কমে গিয়েছিল, কারণ তাদের জীবনের গতিপথ ছিল ভিন্ন। এখানেও তার আপন বলতে কেউ ছিল না।
পঞ্চাশোর্ধ্ব মাহিন এক সকালে বুকে ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলো। ডাক্তার জানাল, তার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। চিকিৎসা চলছিল, কিন্তু প্রবাসের এই হাসপাতালে সে নিজেকে আরও একা অনুভব করল। কেউ ছিল না তার পাশে হাত ধরার, কেউ ছিল না তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার। যে টাকা সে সারা জীবন আয় করেছে, তা দিয়ে তার চিকিৎসা চলছিল, কিন্তু ভালোবাসার স্পর্শটুকু কেনার ক্ষমতা তার ছিল না।
মাসখানেক হাসপাতালে থাকার পর মাহিনকে দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করা হলো। তার শেষ ইচ্ছা ছিল, জীবনের শেষ কটা দিন সে নিজের গ্রামের মাটিতে কাটাবে। যে গ্রাম থেকে স্বপ্ন দেখেছিল উড়াল দেওয়ার, সেই গ্রামের দিকেই তার জীবনের শেষ যাত্রা শুরু হলো। এয়ারপোর্টে নামার পর তাকে হুইলচেয়ারে করে নিয়ে যাওয়া হলো। নিজের চিরচেনা গ্রামকে যখন সে শেষবারের মতো দেখল, তখন তার চোখ ছলছল করে উঠল। চারপাশে স্বজনদের ভিড়, কিন্তু মাহিন তখন অনেক দূরে।
কয়েক দিনের মধ্যেই মাহিন মারা গেল। তার দেহ গ্রামের চিরচেনা মাটিতে শায়িত হলো। যে মাহিন জীবনের প্রথম ভাগে গ্রাম ছেড়েছিল স্বপ্ন পূরণের উদ্দেশ্যে, জীবনের শেষ ভাগে সে ফিরে এল শূন্য হাতে, কেবল মাটির কোলেই তার ঠাঁই হলো। প্রবাসের জীবন তাকে অর্থ দিয়েছিল, কিন্তু জীবনের মূল স্বাদ, ভালোবাসার স্পর্শ, কিংবা পারিবারিক উষ্ণতা থেকে সে বরাবরই বঞ্চিত ছিল। তার কবরের উপর গ্রামের নরম মাটি চাপা পড়ল, আর প্রবাসের একাকীত্ব, সংগ্রাম, আর ত্যাগের এক দীর্ঘ গল্প সেখানেই শেষ হলো।
প্রবাসী জীবন অনেক কষ্টের হয় । তারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে টাকা আয় করে। এবং তাদের সংসার চালায়। 

তাই এক কথায় মানুষ প্রবাসীকে টাকার মেশিন বলে। 🥺

Comments

    Please login to post comment. Login

  • Abiyan Khan 6 months ago

    আপনারা সাপোর্ট করলে আমি অনেক খুশি হব আর নতুন নতুন গল্প বানাতে আগ্রহ হব । ধন্যবাদ