Posts

প্রবন্ধ

নজরুল সাহিত্যে ধর্মের দ্বন্দ্ব: এক পর্যালোচনা

May 30, 2025

মোঃ আব্দুল আউয়াল

Original Author অধ্যক্ষ এমএ আউয়াল

123
View

নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যের এমন এক বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব, যিনি একদিকে যেমন জাতীয়তাবাদ, বিদ্রোহ, সাম্যবাদ ও মানবিক মুক্তির বাণী উচ্চারণ করেছেন, অন্যদিকে তেমনি ধর্মীয় অনুষঙ্গেও বিপুল পরিমাণ সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন। তাঁর সাহিত্য জীবন ধর্মীয় ভাবাবেগে যেমন পরিপূর্ণ, তেমনি সেখানে ধরা পড়েছে এক গভীর অন্তর্দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বই নজরুল সাহিত্যের এক অনিবার্য ও জটিল উপাদান, যা তাঁকে যেমন অনন্য করে তুলেছে, তেমনি বিতর্কিতও করেছে। এই প্রবন্ধে আমরা সেই দ্বন্দ্বের আলোকে নজরুলের সাহিত্যিক অবস্থান, তার অন্তর্নিহিত বিশ্বাস এবং সমালোচনার প্রেক্ষাপট আলোচনা করব।

নজরুল ইসলামের অনেক কবিতা, গান ও প্রবন্ধ ধর্মীয় ভাবাবেগে পূর্ণ। তাঁর ইসলামি গান, হামদ-নাত, রমজান ও ঈদ-নির্ভর কবিতা বাংলা সাহিত্যে এক অনন্য সংযোজন। পাশাপাশি তিনি হিন্দু দেবদেবীকে কেন্দ্র করে বহু কবিতা ও গানে তুলে ধরেছেন শাক্ত, বৈষ্ণব ও পৌরাণিক চেতনা। এই দ্বৈততা থেকেই জন্ম নিয়েছে একটি মৌলিক প্রশ্ন—নজরুল কি একাধিক ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন, না কি তিনি কেবল সাহিত্যিক আবেগে ডুবেই এইসব রচনা করেছিলেন?

সমালোচকরা ঠিক এখানেই নজরুলের "বিশ্বাসযোগ্যতা" নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কেউ কেউ তাঁকে বলেছেন "ইসলাম অন্ধ", আবার কেউ কেউ তাঁকে দেখেছেন "হিন্দুধর্মের কুসংস্কারাচ্ছন্ন অনুসারী" হিসেবে। এদের কেউ কেউ নজরুলের গানে ‘আল্লাহ্ আমার প্রভু, আমার নাহি নাহি ভয়’ এবং অন্যদিকে ‘কালী কালী মন্ত্র জপি’ – এই দুই বিপরীতমুখী অনুভবকে সহাবস্থানযোগ্য মনে করেন না। তাঁদের মতে, ধর্ম একক ও একান্ত বিষয়, এখানে দ্বৈততা মানেই বিভ্রান্তি।

তবে নজরুলকে বোঝার জন্য একপাক্ষিক দৃষ্টিভঙ্গি যথেষ্ট নয়। নজরুল নিজেই তো বলেছিলেন—
“আমি হিন্দু-মুসলমানের মিলনের গান গাই। আমি দুই মন্দিরের একত্রীকরণ চাই, আমি নই কোন নির্দিষ্ট ধর্মের গায়ক।”

নজরুলের ইসলামি গান যেমন মুসলমান সমাজের আত্মিক উন্মেষ ঘটিয়েছিল, তেমনি তাঁর শ্যামাসংগীত, কীর্তন ও পৌরাণিক কবিতা হিন্দু ধর্মালম্বীদের অন্তরে দোলা দিয়েছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন, সাহিত্য একটি সার্বজনীন অভিব্যক্তি, যেখানে বিশ্বাসের বিভাজন নেই; আছে কেবল মানুষ, তার প্রেম, তার কান্না, তার মুক্তি।

এই প্রসঙ্গে বলা যায়, নজরুল যে বিদ্রোহের ধ্বজা বহন করেছেন, তা কেবল রাজনীতি বা ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে ছিল না; তা ছিল ধর্মের কূপমণ্ডূকতা, অসহিষ্ণুতা ও বিভেদের বিরুদ্ধেও। তাই নজরুলের এই দ্বৈত ধর্মীয় উপস্থাপনাকে "কুসংস্কারাচ্ছন্ন" বললে তা নজরুলের বৃহত্তর মনোভঙ্গি ও ইতিহাসবোধকে খাটো করা হয়।

অনেক সমালোচক, বিশেষ করে 'আমার অবিশ্বাস' বইয়ের লেখক, নজরুলের ইসলামি ও শাক্ত রচনাকে 'বাণিজ্যিক' বলে অভিহিত করেছেন। তাঁদের মতে, নজরুল জনপ্রিয়তা ও আর্থিক সাফল্যের জন্য একের পর এক হামদ-নাত ও কালীস্তুতি লিখেছেন। কিন্তু এই অভিযোগ যতটা সরল, বাস্তবতা ততটা নয়।

নজরুল জীবনের এক পর্যায়ে প্রবল আর্থিক দুর্দশায় ছিলেন। সত্য, তাঁর ইসলামি গান কিংবা শ্যামাসংগীত বিক্রি হয়েছে, জনপ্রিয়তা পেয়েছে। কিন্তু তাতে তাঁর শিল্পমান নেমে গেছে এমন বলা যায় না। বরং দেখা যায়, নজরুলের ভাষা, ছন্দ ও ভাবনায় এই গানগুলোও পরিণত হয়েছে চূড়ান্ত শিল্পে। যেমন তিনি লিখেছেন—

“মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই,
যেন গোরে থেকেও মোয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই।”

এর পাশাপাশি তাঁর শ্যামাসংগীতে পাওয়া যায় –

“বল্ রে জবা, বল্ কোন সাধনায়
পেলি শ্যামা মায়ের চরণতল?”

এই দুটি স্তব্ধ মনপ্রাণকে নাড়িয়ে দেয়। তাই এগুলোকে কেবল বাণিজ্যিক বা অন্ধ অনুকরণ বলা যায় না। বরং বলা যায়, নজরুল নিজস্ব অভিজ্ঞতা, ধর্মীয় সংস্পর্শ ও মানবিক আবেগের সমন্বয়ে একটি নতুন ধর্মবোধ নির্মাণ করতে চেয়েছেন।


নজরুলের নারীভাবনা নিয়েও রয়েছে দ্বিধা। ‘নারী’ কবিতায় যেখানে তিনি নারীর সৃজনশীলতা ও মহত্ত্বকে উদযাপন করেছেন, সেখানে ‘পূজারিণী’-তে নারীর অতৃপ্তি ও লোভের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। এই দ্বৈততা কোথা থেকে এল?

একটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হতে পারে, নজরুল নারীকে কখনও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, আবার কখনও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখেছেন। তিনি যেমন নারীর মুক্তির স্বপক্ষে ছিলেন, তেমনি নারীর সীমাবদ্ধতাও চিনে নিতে পেরেছিলেন। তাই তাঁর কাব্যে এই বিপরীত সুর ধ্বনিত হয়েছে।


নজরুলের সাহিত্যে ধর্মের দ্বন্দ্ব যেন ধর্ম নয়, বরং মানুষেরই দ্বন্দ্ব। একদিকে পারিবারিক ও সামাজিক ধর্মচর্চা, অন্যদিকে ব্যক্তিগত প্রতিবাদ ও চিন্তা – এই দুইয়ের টানাপোড়েনে তিনি কখনও লিখেছেন হামদ-নাত, কখনও কালীকীর্তন। কখনও নারীকে বলেছেন মহাশক্তির উৎস, কখনও দেখেছেন তাঁকে দেহের দাসী।

এই দ্বন্দ্বই নজরুলকে আমাদের সময়ের এক জটিল কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ লেখকে পরিণত করেছে। তাঁর সাহিত্যকে শুধুমাত্র ধর্মীয় আবরণের মধ্যে আবদ্ধ করলে, তাঁর ভাবনার গভীরতা ও সাহসিকতা আমাদের চোখ এড়িয়ে যাবে। তাই নজরুলের লেখাকে বিচার করতে হবে তাঁর কালের প্রেক্ষিতে, তাঁর বিপ্লবী মননের প্রেক্ষিতে।

নজরুল সাহিত্য নিয়ে যারা আলোচনা করেন, তাদের কেবল 'খাদেম' না হয়ে সমালোচক হয়ে উঠতে হবে, কিন্তু সেই সমালোচনা হতে হবে প্রজ্ঞাময় ও পরিপূর্ণ, যাতে বিভ্রান্তি নয়, উঠে আসে সেই বিশাল অন্তরাত্মার মুক্তির আর্তি—যেখানে ধর্ম, নারী, জাতি, ভাষা সবকিছু মিলিয়ে এক অনন্য "মানব-নজরুল" গড়ে উঠেছে।

নজরুলের ধর্মীয় দ্বৈততা তাঁর দুর্বলতা নয়, বরং একজন আধুনিক মানুষের অস্থির, জিজ্ঞাসাপূর্ণ, সাহসী চেতনার প্রতিফলন। সেই চেতনার আলোতেই আমরা খুঁজে পাই সাহিত্যের এক ব্যতিক্রমী নক্ষত্র, যাঁর নাম কাজী নজরুল ইসলাম।

Comments

    Please login to post comment. Login