শীতের কনকনে সকালে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের ক্লাসে ঢুকে পড়লেন শিক্ষক মিজান স্যার। ক্লাসের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা ফাহিমকে দেখে তাঁর চোখে কিছুটা উদ্বেগ ফুটে উঠল। গায়ে একটা হালকা ছেঁড়া সোয়েটার, পায়ে স্যান্ডেল আর ঠোঁট নীল হয়ে আসছে ঠান্ডায়।
স্যার ক্লাসে এসে বললেন,
আজ আমি তোমাদের একটা গল্প বলব, তারপর একটা ছোট খেলা খেলব। যে খেলায় জিতবে, তাকে আমি একটা উপহার দেব - একটি উষ্ণ নতুন কম্বল।
সেই কথা শুনে পুরো ক্লাস চনমনে হয়ে উঠল।
তিনি বোর্ডে একটা ধাঁধা লিখে দিলেন:
"যার ঘর নেই কিন্তু সবার ঘরে জায়গা করে নেয়।
ঘুমের সময় সবাই এর মুখোমুখি হয়। সে জিনিসটা কি?"
ছাত্রছাত্রীরা মাথা চুলকাতে লাগল। কেউ বলল ‘আলো’, কেউ বলল ‘রাত’। অনেকেই বলল ‘চাঁদ’।
শেষে ফাহিম হাত তুলল। স্যার জিজ্ঞেস করলেন,
হ্যাঁ ফাহিম, বলো তুমি কী ভেবেছ?
ফাহিম বলল,
স্যার, উত্তরটা হতে পারে 'স্বপ্ন'। স্বপ্নের তো ঘর নেই কিন্তু সবাই ঘুমের সময় স্বপ্ন দেখে।
পুরো ক্লাস চুপ করে গেল। স্যার একটু থমকে গিয়ে হেসে উঠলেন,
সঠিক উত্তর! খুব সুন্দর বলেছ। ফাহিম, তুমি জিতে গেলে।
ফাহিম লজ্জায় মাথা নিচু করল। স্যার নতুন প্যাকেট মোড়ানো একটা নীল কম্বল বের করে বললেন,
এই যে, তোমার জন্য এই উপহার।
ফাহিম কিছু বলল না। কেবল কম্বলটা দু’হাতে নিয়ে বুকের কাছে চেপে ধরল।
পরে টিচার্স রুমে এসে সহকারী শিক্ষক যখন জানতে চাইলেন, “স্যার, আপনি এত আবেগপ্রবণ কেন হয়ে পড়লেন?”
মিজান স্যার বললেন,
“জানো, ওই ধাঁধাটা আমি ইচ্ছে করেই এমনভাবে সাজিয়েছিলাম যাতে ফাহিম জিততে পারে। কারণ আমি জানি, এই শীতের সকালে ওর একটা উষ্ণ কম্বল খুব দরকার কিন্তু ক্লাসের কিছু ছাত্রছাত্রী যে আগে থেকেই নিজেদের মধ্যে ঠিক করে রেখেছিল- কেউ সঠিক উত্তর দেবে না, যেন ফাহিম-ই জেতে, এটা আমি জানতে পারিনি। ওরা চুপ থেকে বা ভুল উত্তর দিয়ে ফাহিমকে সুযোগ দিয়েছে, যাতে ওর প্রাপ্যটা ও পায়। এই বয়সে ওদের মধ্যে যে সহানুভূতি দেখলাম, তা আমাকে নাড়িয়ে দিয়েছে।
তারপর স্যারের চোখ চিকচিক করে উঠল। গলা ভারী হয়ে এল। তিনি ধীরে ধীরে বললেন,
আজ আমি শুধু শিক্ষক নই, একজন শিক্ষার্থী হয়ে শিখলাম- সহানুভূতির চেয়ে বড় কোনো শিক্ষা নেই। ওরা শুধু ভালো ছাত্র নয়, ওরা সত্যিকারের মানুষ হয়ে উঠছে। এটাই আমার শিক্ষকতা জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন।
"যেখানে নিজের প্রয়োজন নয়, অন্যের কষ্টকে গুরুত্ব দেওয়া হয়- সেখানেই জন্ম নেয় সত্যিকারের মানুষ।"
তাং- ৩০/০৫/২০২৫ ইং