Posts

চিন্তা

লোগো বিত্তান্ত 🐾

May 30, 2025

ফারদিন ফেরদৌস

177
View

লোগো হলো একটি চিহ্ন, প্রতীক বা চিত্র যা কোনো প্রতিষ্ঠানের পরিচয় বহন করে। এটি হতে পারে টেক্সট, চিত্র বা উভয়ের সংমিশ্রণ‌ -যার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান, পণ্য, সেবা বা ব্র্যান্ডকে মানুষ সহজে চিনতে পারে। সহজভাবে বললে, লোগো একটি প্রতিষ্ঠানের দৃশ্যমান পরিচয়।

নামকরা প্রতিষ্ঠানের জন্য লোগো একটি অপরিহার্য উপাদান, কারণ এটি প্রতিষ্ঠানটির পরিচিতি, ব্র্যান্ড ইমেজ ও বিশ্বাসযোগ্যতার প্রতীক। একটি স্মরণীয় ও পেশাদার লোগো স্টেকহোল্ডারদের মনে প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থা ও পছন্দ তৈরি করে, যা প্রতিযোগিতামূলক বাজারে আলাদা অবস্থান গঠনে সহায়ক। লোগোর মাধ্যমে একটি প্রতিষ্ঠানকে সহজেই চিনে নেওয়া যায়

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের লোগো তার আদর্শ, লক্ষ্য ও পরিচয়ের প্রতীক হিসেবে কাজ করে। এটি শুধু একটি চিহ্ন নয়, বরং প্রতিষ্ঠানের ঐতিহ্য, দর্শন ও শিক্ষাদর্শের প্রতিফলন। শিক্ষার্থীদের মধ্যে গর্ব, একাত্মবোধ ও আত্মপরিচয় গড়ে তুলতে লোগো সহায়ক ভূমিকা রাখে। একই সঙ্গে অভিভাবক ও সমাজের কাছে প্রতিষ্ঠানের পেশাদারিত্ব ও বিশ্বাসযোগ্যতা প্রতিষ্ঠা করতে লোগো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিভিন্ন সার্টিফিকেট, ইউনিফর্ম, ওয়েবসাইট ও প্রচারণায় ব্যবহৃত লোগো প্রতিষ্ঠানকে চেনার সহজ উপায় হয়ে ওঠে। তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য লোগো একটি প্রয়োজনীয় ও তাৎপর্যপূর্ণ উপাদান।

লোগো নিয়ে আলাপের প্রয়োজনীয়তা কেন পড়ল?
সম্প্রতি দেশে ঘটে যাওয়া রেজিম চেঞ্জের পর বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার নাম পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে লোগো পুনর্নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, অনেক ক্ষেত্রেই এই কাজটি হচ্ছে দায়সারা, অগভীর ও শৈল্পিক দায়িত্বহীনতায় পরিপূর্ণ। প্রতিষ্ঠান প্রধানদের অনেকেই বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিয়ে লোগো ডিজাইনের মতো একটি সূক্ষ্ম শিল্পকর্মকে সাধারণ গ্রাফিক্স ডিজাইনের পর্যায়ে নামিয়ে এনেছেন।
এই প্রবণতা অবশ্যই পরিত্যাজ্য। লোগো নির্মাণের কাজে সম্পৃক্ত হওয়া উচিত সেইসব পেশাদারদের, যাঁরা দেশীয় শিল্প, সংস্কৃতি, লোকজ ঐতিহ্য, প্রতীক, আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য, চিত্রকলার ইতিহাস এবং দেশাত্মবোধে পারদর্শী।

এই প্রসঙ্গে আমরা দেশের পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগোর নান্দনিকতা, দর্শন ও ইতিহাস তুলে ধরতে পারি। যেগুলো প্রমাণ করে -একটি লোগো কীভাবে একটি প্রতিষ্ঠানের আত্মা হয়ে উঠতে পারে। শিক্ষার্থীরা যুগের পর যুগ সেটি নিয়ে গৌরবান্বিত বোধ করতে পারে।

১. জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৭১): জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃষ্টিনন্দন মনোগ্রামের নির্মাতা শিল্পী কালাম মাহমুদ। তিনি এটি পিকক ব্লু রঙে অংকন করেন। মনোগ্রামটি ঐতিহ্যবাহী আলপনাসমৃদ্ধ যা ভাষা আন্দোলনের চেতনার স্মারক। এর মাঝখানে রয়েছে জাতীয় ফুল সাদা শাপলার তিনটি ঊর্ধমুখি পাঁপড়ি। ঊর্ধমুখি পাঁপড়িগুলো জাতির উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও ঊর্ধগামী জীবন-চেতনার বহিঃপ্রকাশ। আর সাদা শাপলার পাঁপড়ি ঘিরে আছে আলপনা আঁকা সমমাপের চারটি পাখা। মনোগ্রামের নিচে বাংলা অক্ষরে ফুলের মালার মতো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম অংকিত আছে। মনোগ্রামটি জাতীয় জীবনের অহংকার ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও ঐক্যের চেতনা বহন করে। শিক্ষার্থীর কাছে এটি যেন প্রাণস্পন্দনের মহান প্রতীক।

২. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (১৯২১):
বাংলা ভাষায় প্রথম উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের লোগো রূপান্তরের ইতিহাসও দারুণ অর্থবহ। সময়ের চাওয়া মাথায় রেখে চারবার এই‌ প্রতিষ্ঠানের লোগো পরিবর্তন করা হয়েছে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও সমরজিৎ রায়চৌধুরীর হাতে তৈরি হয় নতুন লোগো। প্রথমবারের মতো বাংলা লিপির ব্যবহার এবং ‘শিক্ষাই আলো’ স্লোগান যুক্ত হয়। ১৯৭৩ সালে ওই লোগোটি পরিবর্তন করে বর্তমান রূপ দেওয়া হয়। শিল্পী সমরজিৎ রায়চৌধুরী এটি তৈরি করেন। এই লোগোটির তিনটি অংশ। ওপরের দিকে প্রদীপের আলো। তারও ওপরে লেখা -'শিক্ষাই আলো'। নিচে দুই ভাগ করে ডান পাশে একটি চোখ আর বাঁ পাশে শাপলা ফুল। শিল্পী সমরজিৎ রায়চৌধুরী জানান তিনি লোগোতে চোখ এনেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতীক হিসেবে। চোখের মাঝখানে রয়েছে স্বরবর্ণের প্রথম অক্ষর 'অ'। ফুল ব্যবহার করা হয়েছে সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে।

৩. রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৫৩)
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতীকে যুক্ত হয় নতুন দৃষ্টিকোণ। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও হাশেম খানের সহযোগিতায় গঠিত নতুন লোগোতে রয়েছে একটি বৃত্ত (বিশ্ব), খোলা গ্রন্থ (জ্ঞান), শাপলা (জাতীয়তা ও পবিত্রতা), এবং সূর্য (প্রাণশক্তি)। রঙের ব্যবহারেও রয়েছে রুচিশীলতা -কোবাল্ট ব্লু আকাশ ও উদারতার প্রতীক, রক্তলাল জাতীয় পতাকার রং, ও স্বর্ণালী রেখা শিক্ষার গুণগত মানের পরিচায়ক।

৪. চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৬৬):
জাতীয় পতাকার রূপকার শিল্পী কামরুল হাসানের অঙ্কনে এই লোগো প্রকৃতির সৌন্দর্য ও আঞ্চলিক ঐতিহ্যের এক অনন্য রূপায়ণ। চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাম্পান নৌকার সামনের অবয়ব অনুসরণে গঠিত এই লোগোর উপরে রয়েছে পবিত্র কোরআনের আয়াত -“রাব্বি জিদনি ইলমা” (হে প্রভু, আমাকে জ্ঞান দান করো)। খোলা বই, পারমাণবিক প্রতীক, পাহাড় ও সাগরের ঢেউ। সবমিলিয়ে এটি জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রকৃতির এক অদ্বিতীয় সম্মিলন।

৫. খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৯১):
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগো লোকজ সংস্কৃতির ধারায় গঠিত কুলা আকৃতির। ওপরে খোলা বই, মাঝখানে চঞ্চল হরিণ -যা বিশ্ব ঐতিহ্য ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনের স্মারক ও জীবন্ত প্রাণপ্রতীক। নিচে 'U' আকারে লেখা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম, যা ইংরেজি ‘University’ ও ‘Universe’ -উভয়ের প্রতীক। এটি আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য, প্রকৃতির প্রতিচ্ছবি ও জ্ঞান-তৃষ্ণার অনন্য সম্মিলন।

একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের লোগো হতে পারে এর আত্মিক রূপান্তর। তাই এর নির্মাণ যেন হয় ভাবনাপ্রসূত, শিল্পনিষ্ঠ, ঐতিহ্যসংলগ্ন ও স্বকীয়তায় সমুজ্জ্বল। লোগো বানানো যেন শুধু ডিজাইন নয়, বরং হয়ে ওঠে ইতিহাস, দর্শন ও পরিচয়ের শিল্পসন্ধান। নতুন লোগো তৈরির এই সময়ে আমাদের উচিত বিষয়টিকে হালকাভাবে না নিয়ে গভীর শ্রদ্ধা ও দায়িত্বের সঙ্গে দেখা। যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাদের প্রতিষ্ঠানকে দেখে গর্বে মাথা উঁচু করে বলতে পারে -‘এটাই আমার বিশ্ববিদ্যালয়! এটাই আমার প্রাণের শিক্ষায়তন!'

লেখক: সাংবাদিক 
৩০ মে ২০২৫

Comments

    Please login to post comment. Login