এরা লোক ভালোনা। সুযোগ পেলে ডা!কাতি করতেও ছাড়েনা। তাই এদের প্রতি এখন আর সহানুভূতি হয়না আমার।
বিনয়ের এমন কথা, আমার ভালো লাগলোনা মোটেই। সবাই কি আর এক রকম নাকি? দু একজন হয়তো খারাপ হতে পারে, তাই বলে সবাই তো নয়। আমি পঞ্চাশ টাকা ভাড়ার বদলে একশো টাকা দিয়ে নেমে পড়লাম। ওঁরা এই রোদ বৃষ্টিতে যা কষ্ট করে, তাতে সাধ্য থাকলে ওঁদের কিছু টাকা বাড়িয়ে দিলে ক্ষতি নেই। সিটে বসে যখন ওঁদের ঘামে ভেজা জীর্ণ শার্টের দিকে তাকাই, বুকটা হু হু করে ওঠে। মনে হয় যদি সাধ্য থাকতো, তাহলে ওঁদের কষ্ট লাঘবের জন্য নিশ্চয়ই কিছু একটা করে ফেলতাম। কিন্তু বড় কিছু করার সাধ্য তো নেই, তাই এই টুকটাক ভাড়া বাড়িয়ে দেই।
বিনয় আমার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিয়ে বললো, আজ আমার কথাটা পাত্তা দিলি না তো? দেখিস, একদিন ঘা খেয়ে বুঝবি।
আমি বললাম, ওঁদের সম্পর্কে তোর এই ধারণা বদলানো উচিত। গরীব মানুষ ওঁরা, কষ্ট করে খায়!
আর যারা ওদের রিক্সায় চড়ে, তারা কষ্ট করেনা? নাকি তারা রাজাদের শ্রেণিভুক্ত? একটু তেঁতে গিয়ে কথাটা বললো বিনয়।
আমি বললাম, দুর্! কী একটা বিষয় নিয়ে পড়লি বলতো! বাদ দে এখন এসব।
বিনয় আবারো হাসে, ওর হাসিতে কেমন একটা বিদ্রূপ মেশানো। ওর হাসির অর্থ হলো, 'যেদিন ফাঁদে পড়বি সেদিন এসব বড় বড় কথা ছুটে যাবে।' আমি আর পাত্তা দিলাম না। বাসায় চলে এলাম।
কিছুদিন হলো রিমা মাসি নামে একজন আমাদের বাসায় আসেন। বাসার কাজে সাহায্য করেন। ভদ্রলোকেরা যাদেরকে কাজের লোক বলে। রিমা মাসি খুব ভালো মানুষ। অন্তত বাইরে থেকে তাই ই আমার ধারনা। তার সাথে সময় পেলেই গল্প করি আমি। আমার গল্প করার উদ্দেশ্যও আছে একটা, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের জীবনের ছোট ছোট ঘটনা শুনতে ভালো লাগে আমার। জীবনের বৈচিত্র্যটা খুব ভালো করে বোঝা যায় এতে।
আজ লক্ষ্য করলাম রিমা মাসির মুখে হাসি ভাবটা নেই। শুকনো মুখে কাজ করছে। ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, মন খারাপ কেন? কিছু হয়েছে?
রিমা মাসি প্রথমে এড়িয়ে যেতে চাইলো। ও কিছুনা৷ এমনিই। কিন্তু আমি ছাড়লাম না, কী হয়েছে জানতে জোর করলাম। তখন আর লুকাতে না পেরে, নিচু স্বরে বললো, নৈঋতার স্কুলের বেতন দিতে পারিনি দুমাস হলো। মেয়েটা আজ স্কুলে যায়নি। কেঁদেছে সকালে।
শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেলো। ছাত্র পড়িয়ে যে টাকা পাই, তা থেকে প্রতিমাসেই কিছু টাকা আমার কাছে থেকে যায়। তাই কিছু টাকা জমানো ছিলো আমার কাছে। যদিও টাকার অংকটা খুব বড় নয়। সেখান থেকে ছয় হাজার টাকা রিমা মাসির হাতে গুঁজে দিলাম। রিমা মাসি আমার কাছ থেকে টাকাটা নিতে ইতস্তত বোধ করছিলো দেখে বললাম, এ টাকাটা আমার নিজের উপার্জন করা৷ আপনি রাখুন।
সেদিন রিমা মাসির চোখে আমি যে খুশি আর কৃতজ্ঞতা দেখেছিলাম, তার বর্ণনা শব্দ দিয়ে চলেনা।
এরপর প্রায়ই রিমা মাসি আমাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে যেতে চাইতেন। আমার মাকেও বলেছিলেন, কিন্তু যাবো যাবো করে যাওয়া হয়নি কখনো। উনি খুব ভালো পিঠা বানাতে পারতেন। বাড়ীতে পিঠা বানালে আমার জন্য নিয়ে আসতেন কয়েকটা। বেড় করে দিয়েই খেতে বলতেন আমাকে। অর্থাৎ, তার সামনেই যেন খাই একটা। উনি আনন্দ পেতেন এতে। মানুষের বৈশিষ্ট্যই এমন, ভালোবেসে কাউকে কিছু দিলে, সে যদি চোখের সামনেই সেটা একটু ব্যবহার করে, তাহলে ভালো লাগে।
তারপর রিমা মাসি কী একটা সমস্যার কারণে আমাদের বাসায় আর আসতেন না। কী হয়েছিলো আমি আজও জানিনা। ভাঙা পা নিয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়ে রিমা মাসির কথা মনে পড়ছে। সিঁড়ি থেকে পিছলে পড়ে, পায়ে একটা ফ্রাকচার হয়েছে আমার। দুই সপ্তাহ হয়ে গেছে, এখন একটু উঠে দাঁড়াতে পারি৷ কয়েক পা হাঁটতেও পারি৷ কিন্তু বেশিদূর যেতে পারিনা এখনো। ডাক্তার বলেছে আরও সময় লাগবে। কিন্তু আমার পরীক্ষা শুরু হবে দুদিন পর থেকে। যেতেই হবে বাইরে। অবশ্য গাড়ি করেই সবটা পথ যাবো। হাটতে হবেনা মোটেও।
পরীক্ষা শেষে বাড়ি ফেরার জন্য সিএনজির জন্য অপেক্ষা করছি অনেকক্ষণ হলো। কিন্তু পাচ্ছিনা৷ লোকাল বাসেই উঠতে হবে মনে হচ্ছে৷ ভিড় কম এমন একটা বাসে উঠলাম। কিছুদূর যেতেই বাসটা প্রায় খালি হয়ে গেলো৷ মাত্র কয়েকজন জন যাত্রী অবশিষ্ট আছে আর।
একটি মেয়ে নেমে পড়বে এখনি, হেলপার হাক ছাড়লেন, গাড়ি থামান ওস্তাদ, মহিলা নামবে।
মেয়েটি নেমে, বিশ টাকার একটি নোট দিলো। কোনো টাকা ফেরত না দিয়েই গাড়ি চলতে শুরু করলে মেয়েটি পেছন থেকে একটু এগিয়ে বললো, আট টাকা ফেরত দিন।
ভাঙতি নাই আপা। গাড়ি জোরে চলতে শুরু করলো।
মেয়েটি পেছনে দাঁড়িয়ে আর কী বললো শোনা গেলোনা। আমি লোকটার হাতের টাকাগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখলাম, যথেষ্ট ভাঙতি টাকা আছে৷ চাইলেই মহিলাকে ফেরত দিতে পারতো। ইচ্ছে করে দেয়নি। রাগ হলো আমার৷ কি নোংরামি!
লোকটাকে বললাম, এভাবে মানুষ ঠকিয়ে কী লাভ? আপনি চাইলেই তো ওনার টাকাটা ফেরত দিতে পারতেন। আপনাদের এসব আচরণের কারনে আপনাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে মানুষ!
লোকটা কিছুটা উগ্র দৃষ্টিতে তাকালো আমার দিকে৷ আমার ব্যাণ্ডেজ করা পায়ের দিকে তাকিয়ে বললো, গাড়ি আর যাবেনা, নামেন আপনি।
কেন যাবেনা? এটা তো রাস্তার মাথা পর্যন্ত যাওয়ার কথা।
না যাবেনা। আপনি নামেন।
আমি আর কথা বাড়ালাম না, ভাবলাম এখান থেকে রিকশা করে চলে যাবো। নেমে পড়লাম বাস থেকে।
নেমে রিকশার জন্য অপেক্ষা করছি৷ কালো মেঘ করেছে আকাশে, বৃষ্টি নামবে। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে ইতোমধ্যে৷ একটা রিকশা ডাকলাম,
যাবেন?
যাবো।
ভাড়া কত?
দুইশ।
দুইশ? এখানে তো দশ মিনিটেরও পথ না৷ পঞ্চাশ টাকা যাবেন?
না। লোকটা রিকশা ঘুরিয়ে চলে গেলো।
ভাড়া চার গুন বাড়িয়ে চাইছে কেন? ভাবলাম হয়তো নতুন এখানে৷ বৃষ্টি কিছুটা জোরে শুরু হয়েছে৷ একটা রিকশাও দেখা যাচ্ছে না। তখনই আরেকটা রিক্সা এলো। ইনিও ভাড়া অনেক বাড়িয়ে চাইলো। কমে যাবেই না। এদের এমন আচরণ বুঝতে পরলাম না৷ বৃষ্টি নেমেছে বলে ভাড়া বেড়ে গেলো? তাও চার গুণ? এটুকু পথ এত টাকা দিয়ে যেতে হবে? গেলে যাওয়াই যায়, কিন্তু এভাবে অপচয় করে তো যাওয়া উচিত নয়।
ভিজেই যখন গেছি, একটু অপেক্ষা করে দেখি পরিচিত রিকশা পাওয়া যায় কিনা৷ ওইতো একজনকে দেখা যাচ্ছে। এদিকেই আসছে। লোকটাকে আমার ঠিক মনে আছে। কদিন আগেই একে আমি ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছিলাম বলে আমাকে মন খুলে আশীর্বাদ করেছিলো। ইনি হয়তো ঠিক ভাড়াটাই চাইবেন। তারপর পৌঁছে ভাড়া কিছুটা বাড়িয়ে দিবো, ভাবতে ভাবতে, ডাক দিলাম তাকে। ভাড়া জিজ্ঞেস করতেই লোকটা আগের দুজনের চাওয়াটাকেই পুনরাবৃত্তি করলো। আমি অবাক হয়ে তাকালাম লোকটার দিকে! আপনিও এত বাড়িয়ে চাইলেন?
লোকটা যেন আমাকে চিনলোই না। ব্যস্ততার সুরে জিজ্ঞেস করলো, যাবেন এই ভাড়ায়? গেলে লন, নাইনে সরেন!
' গেলে লন, নাইলে সরেন ' কথাটা তীরের মতো বিঁধলো। কী বিভৎস কুৎসিত মানুষের রূপ! অথচ এদেরকে আমি অসহায় ভেবে কত সাহায্য করেছি, কিন্তু আজ দেখছি অসহায় তো আমিই৷ চোখের সামনে ভেসে উঠলো বিনয়ের মুখ, শুনতে পেলাম, ও বলছে, ' আজ আমার কথা পাত্তা দিলি না তো? ঘা খেয়ে তারপর বুঝবি '! সত্যি বিনয়, ঘা খেয়েই বুঝলাম। আমার খারাপ লাগছে ভীষণ, অস্বস্তি হচ্ছে। লোকটা ততক্ষণে কতদূর গেলো তাকিয়ে দেখতে আর প্রবৃত্তি হলোনা৷ বৃষ্টির জোর বেড়েছে, আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকা যায়না, আশে পাশে তাকালাম, কোথাও গিয়ে দাঁড়াবো৷ ঠিক তখনি, একটি মেয়ে ছাতা নিয়ে এসে বললো, অবীন'দা, মা আপনাকে ডাকছেন।
মেয়েটির মুখে আমার নাম শুনে চমকে গেলাম, এমন করে ডাকলো যেন কতদিনের চেনা। অথচ একে তো আমি এই প্রথম দেখছি। জিজ্ঞেস করলাম, তোমার মা ডাকছেন? কে তোমার মা?
মেয়েটি, পেছনে ঘুরে রাস্তার পাশের একটা ঘরের দিকে হাত তাক করে বললো, ওইযে।
আমি তাকালাম, দেখলাম, দরজায় রিমা মাসি দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে যেন এখনো ঠিক সেদিনের মতোই খুশি আর কৃতজ্ঞতা।
|সমাপ্ত|
বিশেষ কছু কথা: সাহিত্যে শ্রমজীবী মানুষের কুৎসিত রূপটা কখনোই দেখানো হয়না৷ সব সময় তাদেরকে অসহায়, নির্যাতিত, অবহেলিত রূপে দেখানো হয়। কিন্তু বাস্তবে শ্রমজীবী হলেই তিনি অসহায় সাধু পুরুষ, এমনটি নয়। কুৎসিত রূপ যেকোনো শ্রেণি-পেশার মানুষের থাকতে পারে। সেসবও সাহিত্যে উঠে আসা উচিত মনে করি। সেই প্রচেষ্টাতেই এই ছোট গল্পটি। গল্পটি কেমন লাগলো? মন্তব্য করে আমাকে উৎসাহিত করতে পারেন৷ ধন্যবাদ।
বিনয়ের এমন কথা, আমার ভালো লাগলোনা মোটেই। সবাই কি আর এক রকম নাকি? দু একজন হয়তো খারাপ হতে পারে, তাই বলে সবাই তো নয়। আমি পঞ্চাশ টাকা ভাড়ার বদলে একশো টাকা দিয়ে নেমে পড়লাম। ওঁরা এই রোদ বৃষ্টিতে যা কষ্ট করে, তাতে সাধ্য থাকলে ওঁদের কিছু টাকা বাড়িয়ে দিলে ক্ষতি নেই। সিটে বসে যখন ওঁদের ঘামে ভেজা জীর্ণ শার্টের দিকে তাকাই, বুকটা হু হু করে ওঠে। মনে হয় যদি সাধ্য থাকতো, তাহলে ওঁদের কষ্ট লাঘবের জন্য নিশ্চয়ই কিছু একটা করে ফেলতাম। কিন্তু বড় কিছু করার সাধ্য তো নেই, তাই এই টুকটাক ভাড়া বাড়িয়ে দেই।
বিনয় আমার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিয়ে বললো, আজ আমার কথাটা পাত্তা দিলি না তো? দেখিস, একদিন ঘা খেয়ে বুঝবি।
আমি বললাম, ওঁদের সম্পর্কে তোর এই ধারণা বদলানো উচিত। গরীব মানুষ ওঁরা, কষ্ট করে খায়!
আর যারা ওদের রিক্সায় চড়ে, তারা কষ্ট করেনা? নাকি তারা রাজাদের শ্রেণিভুক্ত? একটু তেঁতে গিয়ে কথাটা বললো বিনয়।
আমি বললাম, দুর্! কী একটা বিষয় নিয়ে পড়লি বলতো! বাদ দে এখন এসব।
বিনয় আবারো হাসে, ওর হাসিতে কেমন একটা বিদ্রূপ মেশানো। ওর হাসির অর্থ হলো, 'যেদিন ফাঁদে পড়বি সেদিন এসব বড় বড় কথা ছুটে যাবে।' আমি আর পাত্তা দিলাম না। বাসায় চলে এলাম।
কিছুদিন হলো রিমা মাসি নামে একজন আমাদের বাসায় আসেন। বাসার কাজে সাহায্য করেন। ভদ্রলোকেরা যাদেরকে কাজের লোক বলে। রিমা মাসি খুব ভালো মানুষ। অন্তত বাইরে থেকে তাই ই আমার ধারনা। তার সাথে সময় পেলেই গল্প করি আমি। আমার গল্প করার উদ্দেশ্যও আছে একটা, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের জীবনের ছোট ছোট ঘটনা শুনতে ভালো লাগে আমার। জীবনের বৈচিত্র্যটা খুব ভালো করে বোঝা যায় এতে।
আজ লক্ষ্য করলাম রিমা মাসির মুখে হাসি ভাবটা নেই। শুকনো মুখে কাজ করছে। ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, মন খারাপ কেন? কিছু হয়েছে?
রিমা মাসি প্রথমে এড়িয়ে যেতে চাইলো। ও কিছুনা৷ এমনিই। কিন্তু আমি ছাড়লাম না, কী হয়েছে জানতে জোর করলাম। তখন আর লুকাতে না পেরে, নিচু স্বরে বললো, নৈঋতার স্কুলের বেতন দিতে পারিনি দুমাস হলো। মেয়েটা আজ স্কুলে যায়নি। কেঁদেছে সকালে।
শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেলো। ছাত্র পড়িয়ে যে টাকা পাই, তা থেকে প্রতিমাসেই কিছু টাকা আমার কাছে থেকে যায়। তাই কিছু টাকা জমানো ছিলো আমার কাছে। যদিও টাকার অংকটা খুব বড় নয়। সেখান থেকে ছয় হাজার টাকা রিমা মাসির হাতে গুঁজে দিলাম। রিমা মাসি আমার কাছ থেকে টাকাটা নিতে ইতস্তত বোধ করছিলো দেখে বললাম, এ টাকাটা আমার নিজের উপার্জন করা৷ আপনি রাখুন।
সেদিন রিমা মাসির চোখে আমি যে খুশি আর কৃতজ্ঞতা দেখেছিলাম, তার বর্ণনা শব্দ দিয়ে চলেনা।
এরপর প্রায়ই রিমা মাসি আমাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে যেতে চাইতেন। আমার মাকেও বলেছিলেন, কিন্তু যাবো যাবো করে যাওয়া হয়নি কখনো। উনি খুব ভালো পিঠা বানাতে পারতেন। বাড়ীতে পিঠা বানালে আমার জন্য নিয়ে আসতেন কয়েকটা। বেড় করে দিয়েই খেতে বলতেন আমাকে। অর্থাৎ, তার সামনেই যেন খাই একটা। উনি আনন্দ পেতেন এতে। মানুষের বৈশিষ্ট্যই এমন, ভালোবেসে কাউকে কিছু দিলে, সে যদি চোখের সামনেই সেটা একটু ব্যবহার করে, তাহলে ভালো লাগে।
তারপর রিমা মাসি কী একটা সমস্যার কারণে আমাদের বাসায় আর আসতেন না। কী হয়েছিলো আমি আজও জানিনা। ভাঙা পা নিয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়ে রিমা মাসির কথা মনে পড়ছে। সিঁড়ি থেকে পিছলে পড়ে, পায়ে একটা ফ্রাকচার হয়েছে আমার। দুই সপ্তাহ হয়ে গেছে, এখন একটু উঠে দাঁড়াতে পারি৷ কয়েক পা হাঁটতেও পারি৷ কিন্তু বেশিদূর যেতে পারিনা এখনো। ডাক্তার বলেছে আরও সময় লাগবে। কিন্তু আমার পরীক্ষা শুরু হবে দুদিন পর থেকে। যেতেই হবে বাইরে। অবশ্য গাড়ি করেই সবটা পথ যাবো। হাটতে হবেনা মোটেও।
পরীক্ষা শেষে বাড়ি ফেরার জন্য সিএনজির জন্য অপেক্ষা করছি অনেকক্ষণ হলো। কিন্তু পাচ্ছিনা৷ লোকাল বাসেই উঠতে হবে মনে হচ্ছে৷ ভিড় কম এমন একটা বাসে উঠলাম। কিছুদূর যেতেই বাসটা প্রায় খালি হয়ে গেলো৷ মাত্র কয়েকজন জন যাত্রী অবশিষ্ট আছে আর।
একটি মেয়ে নেমে পড়বে এখনি, হেলপার হাক ছাড়লেন, গাড়ি থামান ওস্তাদ, মহিলা নামবে।
মেয়েটি নেমে, বিশ টাকার একটি নোট দিলো। কোনো টাকা ফেরত না দিয়েই গাড়ি চলতে শুরু করলে মেয়েটি পেছন থেকে একটু এগিয়ে বললো, আট টাকা ফেরত দিন।
ভাঙতি নাই আপা। গাড়ি জোরে চলতে শুরু করলো।
মেয়েটি পেছনে দাঁড়িয়ে আর কী বললো শোনা গেলোনা। আমি লোকটার হাতের টাকাগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখলাম, যথেষ্ট ভাঙতি টাকা আছে৷ চাইলেই মহিলাকে ফেরত দিতে পারতো। ইচ্ছে করে দেয়নি। রাগ হলো আমার৷ কি নোংরামি!
লোকটাকে বললাম, এভাবে মানুষ ঠকিয়ে কী লাভ? আপনি চাইলেই তো ওনার টাকাটা ফেরত দিতে পারতেন। আপনাদের এসব আচরণের কারনে আপনাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে মানুষ!
লোকটা কিছুটা উগ্র দৃষ্টিতে তাকালো আমার দিকে৷ আমার ব্যাণ্ডেজ করা পায়ের দিকে তাকিয়ে বললো, গাড়ি আর যাবেনা, নামেন আপনি।
কেন যাবেনা? এটা তো রাস্তার মাথা পর্যন্ত যাওয়ার কথা।
না যাবেনা। আপনি নামেন।
আমি আর কথা বাড়ালাম না, ভাবলাম এখান থেকে রিকশা করে চলে যাবো। নেমে পড়লাম বাস থেকে।
নেমে রিকশার জন্য অপেক্ষা করছি৷ কালো মেঘ করেছে আকাশে, বৃষ্টি নামবে। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে ইতোমধ্যে৷ একটা রিকশা ডাকলাম,
যাবেন?
যাবো।
ভাড়া কত?
দুইশ।
দুইশ? এখানে তো দশ মিনিটেরও পথ না৷ পঞ্চাশ টাকা যাবেন?
না। লোকটা রিকশা ঘুরিয়ে চলে গেলো।
ভাড়া চার গুন বাড়িয়ে চাইছে কেন? ভাবলাম হয়তো নতুন এখানে৷ বৃষ্টি কিছুটা জোরে শুরু হয়েছে৷ একটা রিকশাও দেখা যাচ্ছে না। তখনই আরেকটা রিক্সা এলো। ইনিও ভাড়া অনেক বাড়িয়ে চাইলো। কমে যাবেই না। এদের এমন আচরণ বুঝতে পরলাম না৷ বৃষ্টি নেমেছে বলে ভাড়া বেড়ে গেলো? তাও চার গুণ? এটুকু পথ এত টাকা দিয়ে যেতে হবে? গেলে যাওয়াই যায়, কিন্তু এভাবে অপচয় করে তো যাওয়া উচিত নয়।
ভিজেই যখন গেছি, একটু অপেক্ষা করে দেখি পরিচিত রিকশা পাওয়া যায় কিনা৷ ওইতো একজনকে দেখা যাচ্ছে। এদিকেই আসছে। লোকটাকে আমার ঠিক মনে আছে। কদিন আগেই একে আমি ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছিলাম বলে আমাকে মন খুলে আশীর্বাদ করেছিলো। ইনি হয়তো ঠিক ভাড়াটাই চাইবেন। তারপর পৌঁছে ভাড়া কিছুটা বাড়িয়ে দিবো, ভাবতে ভাবতে, ডাক দিলাম তাকে। ভাড়া জিজ্ঞেস করতেই লোকটা আগের দুজনের চাওয়াটাকেই পুনরাবৃত্তি করলো। আমি অবাক হয়ে তাকালাম লোকটার দিকে! আপনিও এত বাড়িয়ে চাইলেন?
লোকটা যেন আমাকে চিনলোই না। ব্যস্ততার সুরে জিজ্ঞেস করলো, যাবেন এই ভাড়ায়? গেলে লন, নাইনে সরেন!
' গেলে লন, নাইলে সরেন ' কথাটা তীরের মতো বিঁধলো। কী বিভৎস কুৎসিত মানুষের রূপ! অথচ এদেরকে আমি অসহায় ভেবে কত সাহায্য করেছি, কিন্তু আজ দেখছি অসহায় তো আমিই৷ চোখের সামনে ভেসে উঠলো বিনয়ের মুখ, শুনতে পেলাম, ও বলছে, ' আজ আমার কথা পাত্তা দিলি না তো? ঘা খেয়ে তারপর বুঝবি '! সত্যি বিনয়, ঘা খেয়েই বুঝলাম। আমার খারাপ লাগছে ভীষণ, অস্বস্তি হচ্ছে। লোকটা ততক্ষণে কতদূর গেলো তাকিয়ে দেখতে আর প্রবৃত্তি হলোনা৷ বৃষ্টির জোর বেড়েছে, আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকা যায়না, আশে পাশে তাকালাম, কোথাও গিয়ে দাঁড়াবো৷ ঠিক তখনি, একটি মেয়ে ছাতা নিয়ে এসে বললো, অবীন'দা, মা আপনাকে ডাকছেন।
মেয়েটির মুখে আমার নাম শুনে চমকে গেলাম, এমন করে ডাকলো যেন কতদিনের চেনা। অথচ একে তো আমি এই প্রথম দেখছি। জিজ্ঞেস করলাম, তোমার মা ডাকছেন? কে তোমার মা?
মেয়েটি, পেছনে ঘুরে রাস্তার পাশের একটা ঘরের দিকে হাত তাক করে বললো, ওইযে।
আমি তাকালাম, দেখলাম, দরজায় রিমা মাসি দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে যেন এখনো ঠিক সেদিনের মতোই খুশি আর কৃতজ্ঞতা।
|সমাপ্ত|
বিশেষ কছু কথা: সাহিত্যে শ্রমজীবী মানুষের কুৎসিত রূপটা কখনোই দেখানো হয়না৷ সব সময় তাদেরকে অসহায়, নির্যাতিত, অবহেলিত রূপে দেখানো হয়। কিন্তু বাস্তবে শ্রমজীবী হলেই তিনি অসহায় সাধু পুরুষ, এমনটি নয়। কুৎসিত রূপ যেকোনো শ্রেণি-পেশার মানুষের থাকতে পারে। সেসবও সাহিত্যে উঠে আসা উচিত মনে করি। সেই প্রচেষ্টাতেই এই ছোট গল্পটি। গল্পটি কেমন লাগলো? মন্তব্য করে আমাকে উৎসাহিত করতে পারেন৷ ধন্যবাদ।