গল্প: প্রথম ভালোবাসা
নামটা ছিল নীরা।
একটা ছোট শহরের মেয়ে। বাড়ির পাশে বকুল গাছ, স্কুলের মাঠ আর একটা পুরনো লাইব্রেরি। নীরা ছিল সবার চেয়ে আলাদা। চোখের কোণটা সবসময় একটু হাসি হাসি, আর মুখে অদ্ভুত এক মিষ্টি শান্তি।
আর আমি — আরিয়ান। খুব সাধারণ, কোনো আলাদা পরিচয় নেই। স্কুলের এক কোনায় বসা, বইয়ের পাতায় হারিয়ে থাকা একটা ছেলে।
প্রথম যখন দেখেছিলাম ওকে, তখন শ্রাবণ মাস। স্কুলের মাঠে হালকা বৃষ্টি পড়ছিল। সবাই ছুটে দৌড়ে যাচ্ছিল বারান্দার নিচে। আর ও — একা একা ভিজছিল। মাথার ভিজে চুল গুলো ঘাড় বেয়ে নেমে আসছিল। আমি বারান্দা থেকে দেখছিলাম। সেদিন বুঝেছিলাম, এই মেয়েটা অন্যরকম।
পরদিন লাইব্রেরিতে দেখা। হাতে একটা পুরনো বই — “শেষের কবিতা”। আমি তাকালাম, ও হাসল। সেই হাসির মানে আমি আজও বুঝতে পারিনি। শুধু জানতাম, সেই হাসিটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত।
দিন কাটতে থাকলো। কথা বাড়ল। একদিন লাইব্রেরির পেছনের বকুল গাছটার নিচে বসে ও বলল,
“তুমি জানো? শ্রাবণ বৃষ্টি আমার খুব প্রিয়। বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা আমার একরকম ভালো লাগে। মনে হয় সবকিছু ধুয়ে মুছে নতুন হয়ে যাচ্ছে।”
আমি কিছু বলিনি। শুধু দেখছিলাম। মানুষ হয়তো তখনই ভালোবেসে ফেলে, যখন কোনো কিছু না বলেও অন্য কাউকে বুঝতে পারে।
এরপর শুরু হলো আমাদের একসাথে হেঁটে বাড়ি ফেরা, পুরনো গানের লিরিক নিয়ে ঝগড়া, বিকেলে লাইব্রেরির পাশে চা খাওয়া।
আমি অপেক্ষা করতাম স্কুল শেষে। নীরা আসত, ওর খোলা চুলের গন্ধে আমার বুকের ভেতর কেমন করে উঠত।
একদিন সন্ধেবেলা, নদীর ধারে বসে, নীরা বলল,
“তুমি কি কখনো কাউকে ভালোবেসেছো?”
আমি চুপ করে থাকলাম।
ও হাসল। বলল,
“আমি জানি, তুমি ভালোবাসো। আমাকেই।”
আমি অবাক হলাম। বুকের ভেতর এতদিন ধরে লুকানো কথাটা কেউ বুঝে ফেলেছে।
নীরা বলল,
“ভালোবাসা আসলে বলার জন্য নয়। অনুভবের জন্য।”
সেই সন্ধ্যায় আমি ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। কিছুই বলিনি। ওর চোখের মধ্যে কী যেন ছিল — বৃষ্টি, নদীর ঢেউ, অথবা কোনো পুরনো কবিতার লাইন।
এরপর সময় গড়াল। স্কুল শেষ হলো। কলেজে ভর্তি। শহর পাল্টে গেল।
একদিন জানতে পারলাম, নীরা আর এই শহরে নেই। চলে গেছে ওর বাবার ট্রান্সফারে।
কোনো বিদায় হয়নি। কোনো শেষ দেখা, কোনো কথা নয়।
শুধু ও রেখে গেছে একটা পুরনো বই — “শেষের কবিতা”। ভেতরে একটা লাইন লিখে,
“ভালোবাসা কখনো ফুরোয় না। শুধু সময়ের ভেতর হারিয়ে যায়। যখন ফিরে তাকাবে, দেখবে, বৃষ্টির মতোই রয়ে গেছে কোথাও।”
আজও বৃষ্টির দিনে আমি সেই বইটা বের করে রাখি। পাতা উল্টাই। মনে হয়, নীরা বুঝি এখনো আছে।
শহরের ভিড়ে, লাইব্রেরির পুরনো গন্ধে, বা কোনো নাম না জানা সুরের ভেতর।
কখনো কোনো সন্ধ্যায়, শ্রাবণ বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থেকে, মনে হয়, কেউ ডাকছে।
প্রথম ভালোবাসা কখনো ভুলে যাওয়া যায় না।
তা শুধু মনে থাকে।
হালকা ব্যথার মতো।
অথবা নীরব একটা ভালোবাসার মতো।