রাত ১১টা ৪০।
ঢাকা শহরের ব্যস্ততম রেলস্টেশন হঠাৎ করেই যেন থেমে গেছে। দিনের বাকি সময় যেখানে লোকের ভিড়ে দম নেয়া যায় না, এখন সেখানে যেন মৃত্যু নেমে এসেছে।
শোভন দাঁড়িয়ে আছে প্ল্যাটফর্মে, হাওয়াটা কেমন অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা। চারদিকে তাকিয়ে দেখল—কাউন্টারে কেউ নেই, আশেপাশের দোকানগুলোও বন্ধ, হকাররাও উধাও।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বিদ্যুৎ চলে গেল। পুরো স্টেশন অন্ধকারে ডুবে গেল।
হঠাৎই পিছনে কাঁধে একটা হাতের স্পর্শ। শোভন চমকে পিছনে তাকিয়ে দেখে, এক বৃদ্ধ লোক দাঁড়িয়ে, পরনে পুরনো কোট, চোখদুটো ধূসর।
লোকটা ফিসফিস করে বলল,
“শেষ ট্রেনটা গেছে। তুমি এসেছ এক মিনিট দেরিতে।”
শোভন কাঁপতে কাঁপতে বলল, “কিন্তু ট্রেনের আওয়াজ তো এখনই শুনলাম!”
লোকটা হাসল—একটা বিকৃত, ঠোঁটহীন হাসি।
“যেটা শুনলে, সেটা জীবিতদের ট্রেন না।”
শোভনের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। সামনে তাকিয়ে দেখল, প্ল্যাটফর্ম ৪ থেকে একটা পুরনো, ধোঁয়াচ্ছন্ন ট্রেন ঢুকছে স্টেশনে।
কিন্তু সমস্যা একটাই—প্ল্যাটফর্ম ৪ তো তিন বছর ধরে বন্ধ।
স্টেশনজুড়ে থমথমে অন্ধকার। বিদ্যুৎ নেই, মোবাইলের নেটওয়ার্কও যেন হঠাৎ উধাও।
শোভনের বুক ধকধক করে। প্ল্যাটফর্ম ৪-এর দিকে চোখ আটকে গেছে—সেখানে একটা পুরনো রঙচটা ট্রেন ধীরে ধীরে থেমে দাঁড়াচ্ছে।
এই প্ল্যাটফর্মটা তিন বছর আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ভয়াবহ এক দুর্ঘটনার পর। গুজব ছিল, সেদিনের ট্রেনে যারা ছিল, তারা নাকি কেউ ফিরেনি।
কিন্তু এখন?
এই ট্রেনটা তাহলে এল কোথা থেকে?
দরজা খুলে গেল—একটা ধোঁয়াটে শব্দে। ভেতরটা অদ্ভুত অন্ধকার, যেন আলো ঢুকতে পারে না।
শোভন কাঁপা হাতে পা বাড়ালো।
ভেতরে পা রাখতেই দরজা জোরে বন্ধ হয়ে গেল।
ট্রেনের ভিতরটা নরমাল মনে হলেও কেমন একটা গন্ধ... পচা মাংসের মতো।
সিটে বসে আছে কিছু যাত্রী—তবে সবাই যেন অস্বাভাবিক চুপচাপ।
কেউ তাকাচ্ছে না, কেউ নড়ছে না।
শুধু সামনের দিক থেকে একটা মেয়ে ঘাড় নিচু করে কাঁদছে। তার গায়ের জামায় রক্ত।
শোভন আস্তে করে বলল, “আপনি ঠিক আছেন?”
মেয়েটি ধীরে ধীরে মুখ তুলল।
চোখদুটো শূন্য, ঠোঁট ছেঁড়া, গলা দিয়ে ফিসফিস করে বলল—
“তুমিও ফিরতে পারবে না…”
ট্রেনটা দুলে উঠলো হঠাৎ, জানালার বাইরে অন্ধকার ছুটে যেতে লাগল।
শোভন চিৎকার করে উঠল—“এই ট্রেন যাচ্ছে কোথায়?”
আর ঠিক তখনই—একটা ঘোষণা ভেসে এলো ট্রেনের ভেতরের স্পিকারে,
“পরবর্তী স্টেশন—মৃতপুর।”
শোভনের মুখ শুকিয়ে এসেছে। ট্রেনের ভেতরের বাতাস ভারী—জানা যায় না কি আছে আর কি নেই।
যাত্রীরা এখনো নিশ্চুপ, যেন মোমের পুতুল। কেউ চোখ পর্যন্ত নাড়িয়ে দেখছে না। তাদের চোখদুটো যেন কুয়াশায় ঢাকা, অথচ খোলা।
ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য কিছুই বোঝা যায় না—অন্ধকারের ভিতর অদ্ভুত অদ্ভুত ছায়া ঘুরে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ একটা দীর্ঘশ্বাসের মতো শব্দ কানে এলো, যেন কেউ ঠিক তার কানের পাশে দাঁড়িয়ে নিশ্বাস নিচ্ছে।
শোভন ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। মেয়েটার দিকে আর না তাকিয়ে সে ট্রেনের সামনের দিকের বগির দিকে এগিয়ে যেতে লাগল।
কিন্তু ট্রেনটা যেন শুধু লম্বা হয়ে যাচ্ছে।
একটা দরজা, তারপর আরেকটা, তারপর আরেকটা—শেষই নেই।
হঠাৎ একটা দরজার সামনে এসে থামল। এ দরজাটা তালাবদ্ধ। দরজার ওপাশ থেকে ভেসে এল কিছু শব্দ—
“কেউ একজন এখনো বেঁচে আছে... ওর গন্ধ পাচ্ছি…”
শোভনের শিরদাঁড়া দিয়ে ঠাণ্ডা কিছু বয়ে গেল। পেছনে তাকিয়ে দেখল—একটা যাত্রী উঠে দাঁড়িয়েছে। মুখ ঢাকা, শরীরটা কাঁপছে। ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে আসছে।
শোভন ছুটে পালাতে চাইলো, কিন্তু ট্রেন যেন তার পা আটকে রাখছে। দরজা ঠেলেও খুলছে না।
ঠিক সেই সময়, ডানদিকের জানালায় মুখ লাগিয়ে তাকিয়ে থাকে একটা ভয়ানক মুখ—চোখ নেই, কেবল গর্ত, তবুও যেন দেখছে তাকে।
স্পিকারে আবার ঘোষণা এলো—
“মৃতপুর পৌঁছাতে আরও এক যাত্রীর প্রয়োজন।”
এবার শোভনের মাথায় ঘুরতে লাগলো—
এই ট্রেনে সে উঠল কেন? এই ট্রেনটা কি তাকে খুঁজেই নিয়েছে?
সে কি একা, নাকি তার মতো আরও কেউ আছে এখানে?
হঠাৎ তার মোবাইলটা কম্পন করল। স্ক্রিনে ভেসে উঠল একটা ম্যাসেজ—
"পেছনে তাকিও না।"
শোভনের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো। কারণ সে বুঝতে পারছে—পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে।
শোভনের শরীরটা হিম হয়ে গেল। ঠাণ্ডা ঘাম কপাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে।
সে নড়তে পারছে না, নিঃশ্বাস আটকে আছে। যেন সময় থেমে গেছে।
পেছনে কারো উপস্থিতি যেন ধীরে ধীরে চারপাশের বাতাস টেনে নিচ্ছে—সবকিছু ভারী, ঘন আর নিঃশব্দ।
অবশেষে, ভীতু হাতে সে মোবাইলের আলোটা ঘুরিয়ে পেছনে তাকাল।
সামনেই—একটা নারী মূর্তি। দাঁড়িয়ে, মাথা নিচু, লম্বা চুল সামনে ঝুলে আছে। চুলের ফাঁকে ফাঁকে তার গলার কাছ থেকে শুরু করে গলা কাটা দাগ দেখা যাচ্ছে।
তার জামাটাও ভিজে, যেন কিছুক্ষণ আগেও রক্তে ডুবে ছিল।
মেয়েটার ঠোঁট নড়ে উঠল। খুব আস্তে, ফিসফিসে কণ্ঠে বলল:
“তুই নামলি কেন?... সবাই তো মরেছে...”
শোভনের মুখ দিয়ে একটা নিঃশব্দ চিৎকার বেরিয়ে এলো।
সে পেছন ঘুরেই ছুটতে চাইল, কিন্তু পা যেন কনকনে ঠাণ্ডা কাদায় আটকে গেছে।
তখনই ট্রেনের স্পিকারে আবার ঘোষণা হলো—
“মৃতপুর আসছে… সবাই প্রস্তুত হোন... নতুন যাত্রীর নাম লেখা হয়ে গেছে।”
শোভনের চোখ মোবাইল স্ক্রিনে গেল—
স্ক্রিনে অটোমেটিক ভেসে উঠেছে তার নাম। নিচে লেখা—
“Boarded: Shovon Banik | Seat: Final.”
তারপর ট্রেনের জানালায় হঠাৎ আলো জ্বলে উঠল। বাইরের অন্ধকারে ছায়ারা নড়ে উঠেছে।
তাদের দিকে তাকিয়ে শোভনের মনে হলো—এই ট্রেন সে নিজেই ডেকেছে।
এই ট্রেন, এই যাত্রা—হয়তো তার সাথেই জন্মসূত্রে জড়িত।
শোভন জানে, সে এখন আর সাধারণ কোনো ট্রেনে নেই। এই যাত্রা একেবারেই ব্যতিক্রম, এবং সম্ভবত একমুখী।
মোবাইলের স্ক্রিনে নিজের নাম দেখে তার বুক ধকধক করতে লাগল।
Seat: Final.
এই শব্দটা তার মাথার ভেতরে ঘুরপাক খাচ্ছে।
চারপাশের যাত্রীরা ধীরে ধীরে তাকাতে শুরু করেছে তার দিকে। তাদের চোখে নেই কোনো সাদা অংশ—সব কেবল কালো। মুখে হাসি, কিন্তু সেই হাসিতে আতিথেয়তা নেই, আছে কেবল শিকার পাওয়ার আনন্দ।
শোভন ছুটে যেতে লাগল সামনের দিকে—একটা, দুটো, তিনটা বগি পার হয়ে গেল।
হঠাৎ সে একটা দরজার সামনে এসে থেমে গেল—উপরের ছোট্ট বোর্ডে লেখা:
“নির্বাচিত যাত্রীদের কেবিন”
দরজাটা নিজে থেকেই খুলে গেল, যেন তার জন্যই অপেক্ষায় ছিল।
ভেতরে ঢুকেই শোভন দেখল, ঘরটা আধা অন্ধকার, মাঝখানে একটা পুরনো কাঠের টেবিল আর তার ওপাশে বসে আছে সেই বৃদ্ধ লোকটা—যে স্টেশনে বলেছিল, “শেষ ট্রেনটা গেছে।”
এবার তার চোখদুটো পুরোপুরি কালো, আর ঠোঁটহীন মুখে সেই বিকৃত হাসি।
বৃদ্ধ লোকটা শোভনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোর আসার কথা ছিল আগেই। দেরি করেছিস...”
“এখন আমাদের একজনকে জায়গা দিতে হবে... ট্রেন কখনো খালি যায় না।”
টেবিলের উপর রাখা পুরনো রেজিস্টারে নিজের নাম দেখে শোভনের পা কাঁপতে লাগল।
সে জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু আমি তো টিকিট কাটি নাই... আমি তো জানতাম না...”
লোকটা বলল,
“তোর দাদার নামও ছিল এই রেজিস্টারে। সে শেষ মুহূর্তে বাঁচতে পেরেছিল। কিন্তু... তার দায় রয়ে গেছে রক্তে।”
শোভনের মাথা ঝিমঝিম করছে। ট্রেন আবার দুলতে শুরু করল।
ট্রেন থেমে যাচ্ছে... কোথায়? মৃতপুরে? নাকি আরও গভীরে?
ঠিক তখনই জানালার বাইরে থেকে এক শিশু কণ্ঠ চিৎকার করে উঠল—
“ভাইয়া, নেমে যা! এই ট্রেন তোর না!”
শোভনের চোখ ছানাবড়া—ও কণ্ঠটা তার ছোট ভাই অয়ন-এর!
কিন্তু অয়ন তো... ছয় বছর আগে হারিয়ে গিয়েছিল।
ট্রেনের দরজা আবার খুলতে শুরু করল, আর সেই সঙ্গে একটা সুযোগ…
এই ট্রেন থেকে কি শোভন পালাতে পারবে? নাকি এই ট্রেনেই শুরু হবে তার অনন্ত যাত্রা?
শোভনের চোখ কেবল জানালায় আটকে আছে।
অন্ধকারের মাঝে ছোট্ট এক ছায়া, যে চিৎকার করে বলেছিল—
"ভাইয়া, নেমে যা! এই ট্রেন তোর না!"
শোভনের গলার শব্দ বের হয় না, চোখে জল চলে আসে।
"অয়ন...? তুই... তুই কোথায় ছিলি?"
কিন্তু উত্তর আসে না, শুধু ছায়াটা হঠাৎ মিলিয়ে গেল ঘন কুয়াশায়।
দরজাটা ধীরে ধীরে আবার বন্ধ হয়ে গেল।
বৃদ্ধ লোকটা এবার রেজিস্টারের পাতা উল্টাচ্ছে। পৃষ্ঠা থেকে ধোঁয়া উঠছে, আর প্রতিটা পাতায় শুধু নাম আর তারিখ—কারো পাশে লেখা “ফিরেছে”, কারো পাশে “থেমে গেছে”।
শোভনের দাদার নামের পাশে লেখা ছিল “ফিরেছে”।
কিন্তু তার নিচে—
“পরবর্তী উত্তরাধিকার: শোভন”
শোভন কাঁপা গলায় বলল,
“তাহলে এই দায় আমার পরিবার থেকে আসে?”
লোকটা এবার গভীর গলায় বলল,
“মৃতপুর কারও বাসস্থান না।
কিন্তু কেউ যদি একবার ট্রেন ছাড়ার সময় ভুল করে...
তবে তার ছায়া ফিরে আসে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য।”
“এই ট্রেন তোর রক্তের স্মৃতির ফল। এটা তোকে বহন করতেই হবে।”
শোভন চোখ বন্ধ করল। চারপাশ যেন গরম হয়ে উঠছে, ট্রেনের গায়ে লালচে আগুনের রেখা দেখা যাচ্ছে।
ঠিক তখনই একটা দরজা ঠেলে খুলে যায়। পেছন থেকে আসছে সেই মেয়েটার কণ্ঠ—
“তুমি পালাতে পারো… কিন্তু একটা শর্তে।”
শোভন ঘুরে তাকাল।
রক্তমাখা মেয়েটা দাঁড়িয়ে, এবার তার চোখে ভয় নয়—একটা আর্তি।
“যদি কেউ তোমার জায়গা নেয়, তাহলে তুমি ফিরতে পারো।”
শোভন চমকে গেল।
“মানে?”
মেয়েটা বলল,
“তোমাকে কাউকে আনতে হবে… একা, এক মিনিট দেরি করে… ঠিক যেমন তুমি এসেছিলে।”
শোভন নিশ্চুপ। চোখে পানি।
এই যাত্রা কি সত্যিই শেষ করা সম্ভব? নাকি বাঁচতে হলে তাকে… অন্য কাউকে মৃত্যুর টিকিট দিতে হবে?
ট্রেনের ঘড়িতে সময় বাজছে—
১১টা ৩৯।
ট্রেনের বাতাস আবার ভারী হয়ে উঠছে।
ঘড়িতে বাজছে ১১টা ৩৯, মানে… আবার সেই মুহূর্ত ফিরে আসছে।
যে মুহূর্তে শোভন স্টেশনে পৌঁছেছিল—মাত্র এক মিনিট দেরিতে।
মেয়েটা ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে বলল,
“তোমার সামনে এখন দুটো রাস্তা। হয় তুমি থেকে যাও—যেমনটা হয়েছে আমাদের সবার সাথে। অথবা...”
সে থামল, শোভনের চোখে চোখ রেখে বলল,
“অথবা তুমি বাঁচতে পারো—কারো বদলে।”
শোভনের মাথায় যেন হাতুড়ির মতো শব্দ বাজে।
বাঁচতে হলে কাউকে নিয়ে আসতে হবে…
সে ভাবছে—কার? কে তার জায়গা নিতে পারে? এমন কাউকে কি সে চেনে?
ঠিক তখনই ট্রেনের ভেতর অদ্ভুত এক কম্পন শুরু হল। ট্রেন আবার চলতে শুরু করেছে।
বৃদ্ধ লোকটা হাসছে সেই বিকৃত হাসি, বলছে,
“সময় ফুরিয়ে আসছে, বাছাই কর—নইলে ট্রেন আপনাকে বেছে নেবে।”
হঠাৎই চারপাশটা ঝাপসা হতে লাগল।
শোভন চোখ মেলতেই দেখল—সে আর ট্রেনের ভেতরে নেই।
সে দাঁড়িয়ে আছে সেই পুরোনো স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে—১১টা ৩৮ বাজে।
লোকজন ঘুরে বেড়াচ্ছে, হকাররা ডাকছে, দোকান খোলা…
সব যেন স্বাভাবিক।
কিন্তু সে জানে, এই বাস্তব নয়। এটা একটা ফাঁদ।
এক পাশে বসে আছে তার পুরোনো বন্ধু রনি—যার সাথে বহুদিন কথা হয়নি।
রনি তাকে দেখে হাসছে, বলছে,
“দোস্ত! কই থাকিস? চল, শেষ ট্রেনের টিকিট কাটছি, একসাথে যাব।”
শোভনের কানে শুধু একটা কথাই বাজছে—
“তাকে আনতে পারলেই তুমি বাঁচবে…”
তার হাতে এখন সুযোগ আছে। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত তাকে চিরকাল তাড়িয়ে বেড়াবে।
রনির মুখটা হাসছে, বিশ্বাসভরা চোখে তাকিয়ে আছে।
শোভনের হাতে সময় মাত্র এক মিনিট।
সে কী করবে? নিজের জীবন বাঁচাবে, নাকি… বন্ধুকে বাঁচাবে?
ঘড়ি বলছে—১১টা ৩৯।
---
ঘড়ির কাঁটা ১১টা ৩৯ পার হয়ে ৪০-এ পৌঁছানোর অপেক্ষায়।
মাত্র এক মিনিট—এটাই ঠিক করবে, শোভন বাঁচবে কি না।
রনি এখনও প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চে বসে আছে, হাসছে।
এক হাতে টিকিট, অন্য হাতে চা।
“চল না রে, দেরি হলে ট্রেন মিস করবি!”
রনি বলল, আর শোভনের দিকে একটা টিকিট বাড়িয়ে দিল।
শোভনের গলা শুকিয়ে গেছে। হাত কাঁপছে।
সে জানে—এই মুহূর্তে রনিকে ট্রেনে উঠতে দিলে সে ফিরবে না।
এই ট্রেন তার বন্ধুটা কেড়ে নেবে।
আর তখন শোভন বেঁচে যাবে… মুক্তি পাবে… সব ভুলে যেতে পারবে…
কিন্তু—
একটা প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে—
“আমি যদি বাঁচতেও পারি, নিজের বিবেককে কী জবাব দেব?”
রনির মুখে সেই নিষ্পাপ হাসি।
সে কিছুই জানে না।
কোন দুঃস্বপ্নের মুখোমুখি হতে চলেছে, তার ধারণা নেই।
ঠিক তখনই প্ল্যাটফর্মের ঘড়িতে ১১:৪০ বাজল।
একটা বিকট বাঁশির শব্দ। ধোঁয়ায় ঢাকা সেই ট্রেন ঢুকছে প্ল্যাটফর্ম ৪-এ।
যেখানে এখনো “বন্ধ” লেখা ঝুলছে… অথচ ট্রেন থেমে যায়।
রনি উঠে দাঁড়াল।
“চল দোস্ত, উঠে পড়ি।”
শোভনের মাথা ঝিমঝিম করছে। কানে শোনা যাচ্ছে সেই পরিচিত কণ্ঠ—
“কারও না কারও প্রয়োজন আছে… নয়তো ট্রেন থামে না…”
আর তখনই…
শোভন রনির হাত চেপে ধরল।
“তুই যাবি না!”
রনি অবাক হয়ে তাকাল,
“কী বলছিস? তোর মাথা খারাপ?”
“এই ট্রেনটা… এটা আমাদের জন্য না রে। শুধু বিশ্বাস কর।”
শোভনের চোখে পানি। শরীর কাঁপছে।
“তুই থাক… আমি যাব।”
রনি হতভম্ব, কিন্তু শোভনের চাহনি দেখে সে আর কিছু বলল না।
ট্রেনের দরজা খুলছে।
শোভন এক পা এক পা করে এগিয়ে গেল।
টিকিট তার হাতে, কিন্তু এবার আর হাত কাঁপছে না।
সে জানে, সে কারো জীবন বাঁচিয়েছে।
দরজার ভেতর অন্ধকার, কুয়াশা।
ভেতর থেকে সেই মেয়েটার গলা শোনা যাচ্ছে—
“তুমি ফিরতে পারবে না, কিন্তু তুমি মানুষ রয়ে গেলে।”
দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
রনি চিৎকার করে বলল,
“শোভন! না রে!!”
কিন্তু ট্রেন তখন চলতে শুরু করেছে…
বাইরে প্ল্যাটফর্মে ঘড়িতে সময় ১১টা ৪১।
---
শোভন দরজা দিয়ে ঢুকেই টের পেল—এই ট্রেন আগের সেই ট্রেন নয়।
এটা যেন আরও গভীর, আরও নীরব, আর যেন… জীবন্ত।
দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এক অদ্ভুত চাপ অনুভব করল সে—
শ্বাস নেওয়া কষ্টকর, বাতাস ভারী, কেমন একটা পচা স্যাতস্যাতে গন্ধ।
বাতি জ্বলছে কিন্তু আলো ছড়িয়ে পড়ছে না।
দেয়ালগুলোতে অদ্ভুত সব দাগ—কারও হাত, কারও নখ, কেউ যেন এখান থেকে বের হতে চেয়েছিল… পারেনি।
সামনের কেবিনে বসে আছে সেই বৃদ্ধ।
চোখে ঘোলা দৃষ্টি, কিন্তু এবার মুখে সেই ঠোঁটহীন হাসি নেই।
“তুমি ফিরে যেতে পারতে। কিন্তু তুমি চয়ন করেছ পথটা।”
শোভন বলল, “আমি জানি। তবে আমি কাউকে ঠেলে মুক্তি নিতে চাইনি।”
বৃদ্ধ বলল, “তোমার মতো একজন অনেক বছর পর এসেছ। তোমাদের দুনিয়ায় আত্মত্যাগ শব্দটা এখনও আছে—জানি না, ভালো না খারাপ।”
ট্রেন চলতেই থাকে। বাইরের দৃশ্য পাল্টায় না—একটানা অন্ধকার, মাঝে মাঝে ভেসে ওঠে ধ্বংসস্তূপ, পুড়ে যাওয়া গাছ, মাথাবিহীন ছায়া…
হঠাৎই ট্রেনটা ঝাঁকি খেল।
স্পিকারে আবার ভেসে এলো সেই ভয়ানক ঘোষণা—
“পরবর্তী স্টেশন—জাগরণপুর। শুধুমাত্র আত্মত্যাগকারীদের জন্য।”
শোভন ভাবল,
জাগরণপুর? এটা কোথায়? আমি কি মরেছি? নাকি এটা অন্য কোনো বাস্তবতা?”
ট্রেন থামল। দরজা খুলল না।
একটা কালো ছায়া ট্রেনের মধ্যে ঢুকল, ধীরে ধীরে শোভনের দিকে এগিয়ে এল।
ছায়াটা কথা বলল না, শুধু একটা আয়না বাড়িয়ে দিল তার দিকে।
শোভন আয়নায় তাকিয়ে দেখল…
সে নিজেকে দেখতে পাচ্ছে না। আয়নায় দাঁড়িয়ে আছে একটা শিশুর মতো সত্তা—চোখে ভয়, মুখে রক্ত।
তার ঠোঁট না থাকলেও কণ্ঠ শুনতে পেল—
“তুমি কি আমার জায়গা নিচ্ছ?”
শোভনের বুক কেঁপে উঠল। সে বুঝতে পারল—এই আত্মা, এই শিশুটি বহু বছর আগে এই ট্রেনে হারিয়ে গিয়েছিল। আর এখন সে মুক্তি চায়।
শোভন হাত বাড়িয়ে বলল, “চলো, আমি তোমাকে বাইরে নিয়ে যাব।”
শিশুটির চোখে আশ্চর্য এক আলোর ঝলক। ট্রেন কেঁপে উঠল আবার, হঠাৎ আলো ফেটে পড়ল চারপাশে।
সবকিছু ঝাপসা…
---
শোভনের চোখ খুলল।
সে পড়ে আছে প্ল্যাটফর্মে, রাত ১১টা ৪২।
রনি তার পাশে বসে, চোখে জল।
“তুই হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়লি রে! ডাক্তার ডাকতে যাচ্ছিলাম!”
শোভন উঠে বসে চারপাশ দেখে—স্টেশন স্বাভাবিক, সবকিছু আগের মতো।
কিন্তু তার হাতে একটা পুরনো, ছেঁড়া টিকিট।
উপর লেখা—"Return from Jagaranpur – One Way Only"
শোভন জানে—সে ফিরে এসেছে।
কিন্তু একা না।
তার পেছনে, এক কোণে, একটা শিশু চুপচাপ দাঁড়িয়ে।
সে আর রক্তমাখা না, মুখে শান্ত হাসি।
শোভনের দিকে তাকিয়ে সে ফিসফিস করে বলল,
“তোমার কারণে আমি মুক্ত…
---
স্টেশন ছেড়ে শোভন হাঁটছে ধীর পায়ে।
রনি পাশে, কিন্তু শোভনের মনে অদ্ভুত এক ভার।
যা সে দেখেছে, যা সে অনুভব করেছে—সব যেন স্বপ্ন, অথচ হাতে ধরা সেই ছেঁড়া টিকিটটা বলে দিচ্ছে এটা বাস্তব।
হঠাৎ মোবাইল বেজে উঠল।
অচেনা নাম্বার, কণ্ঠটা রোবটের মতো—
“তুমি একবার ফিরে এসেছ। কিন্তু শেষ ট্রেনটা এখনও যায়নি। অন্য কেউ এখন চড়তে চলেছে। তুমি কি দেখবে কারা যায়?”
শোভন কাঁপতে কাঁপতে বলল, “কে তুমি?”
কণ্ঠস্বর নিস্তেজ হাসি দিল,
“ট্রেনটার টিকিট যারা পায়, তারা আর আগের মানুষ থাকে না। এবার তোমার পালা, দেখার।”
কথা শেষ হতে না হতেই রনির মোবাইল বেজে উঠল।
সে চোখ কুঁচকে বলল, “আচ্ছা, আজব একটা ম্যাসেজ এসেছে... শেষ ট্রেনটা কোথায় যায় জানিস?”
শোভনের শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল।
সে বুঝতে পারল—ট্রেন এবার রনির জন্য এসেছে।
প্ল্যাটফর্মের ঘড়িতে সময় রাত ১১টা ৪০।
ঠিক তখনি হুইসেলের মতো একটা বিকট শব্দ।
প্ল্যাটফর্ম ৪—যা বন্ধ ছিল সেই ভয়াল রাতের পর থেকে—হঠাৎ আলো জ্বলে উঠল।
একটা পুরনো ট্রেন ধীরে ধীরে ঢুকছে।
রনি অবাক হয়ে বলল,
“ওইটা তো ট্রেন! তুইও দেখছিস?”
শোভন কিছু বলল না।
সে জানে—এই ট্রেন সবসময় দেখা যায় না, সবসময় সবাই দেখতে পায় না।
শুধু সে, যার সময়ের ঘড়ি বেজে উঠেছে—সে-ই দেখে, সে-ই ওঠে।
রনি আগাতে শুরু করল প্ল্যাটফর্ম ৪-এর দিকে।
শোভন চিৎকার করে উঠল, “না রনি! থেমে যা!”
কিন্তু রনি শুনছে না।
চোখে একরকম ঘোর, মুখে কৌতূহল।
ট্রেনটা থেমেছে। দরজা খুলেছে। ধোঁয়া উঠছে।
আর রনি সেই ধোঁয়ার মধ্যে হারিয়ে যেতে যেতে একবার পিছনে তাকাল।
চোখে শূন্যতা।
শোভন ছুটে গিয়ে ধরতে পারল না তাকে।
দরজা বন্ধ।
ট্রেন চলতে শুরু করল।
পেছনে পড়ে রইল শুধু একটা ছেঁড়া টিকিট।
তাতে লেখা—
"Next Passenger: Confirmed."
---
শেষ।
তবে হয়তো না।
কারণ শেষ ট্রেনটা… এখনও যায়নি।