সে অনেকদিন আগের কথা—প্রায় দু’বছর হবে। নদী তখন নবম শ্রেণিতে পড়ে। সে ছিল এক মেধাবী ছাত্রী, শিক্ষকদের নয়নের মণি এবং সবার প্রিয়। সারাদিন শুধু পড়ালেখা নিয়ে থাকত; খেলাধুলার প্রতি তেমন আগ্রহ ছিল না। মিষ্টি স্বভাব, শান্ত মেয়ে ছিল নদী, খুব কম কথা বলত। কেউ অসুবিধায় পড়লে, পড়া না বুঝলে সবার আগে ছুটে যেত নদীর কাছে। সততা, নিষ্ঠা, সত্যবাদিতা আর সহানুভূতিতে ছিল তার পরিচয়।
তবে তার আরও একটি বিশেষ গুণ ছিল—গান গাওয়া। নদীর গলা ছিল অপূর্ব। তার সুরেলা কণ্ঠে গান শুনে সবাই মুগ্ধ হয়ে যেত। সে ছিল অপরূপ রূপবতী—ঘন কালো চুল, মায়াবী চোখ আর উজ্জ্বল গায়ের রং সহজেই সবার দৃষ্টি কাড়ত।
কিন্তু এই রূপই যেন তার জীবনে অভিশাপ হয়ে নেমে এল।
এলাকার এক প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর ছেলে পলাশ পড়ত কলেজে। তার ছিল বখাটে ছেলেদের সঙ্গে ওঠাবসা। তারা নেশা করত, মেয়েদের উত্যক্ত করত, ভয় দেখাত। পলাশের চোখ পড়ে নদীর ওপর। প্রতিদিন স্কুলে যাওয়া-আসার পথে সে নদীকে উত্যক্ত করতে শুরু করে।
নদী মানসিকভাবে ভেঙে পড়তে শুরু করল। পড়াশোনায় অমনোযোগী হয়ে গেল, রাতে ঘুম হত না। পলাশ ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা প্রায়ই নদীর বাড়ির আশেপাশে ঘোরাফেরা করত।
একদিন পলাশ নদীর পথ আটকে তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। নদী কোনো দ্বিধা না করে তার গালে সজোরে চড় মারে। অপমানিত পলাশ তখন হুমকি দেয়—বিয়ে না করলে নদীর জীবন সে ধ্বংস করে দেবে।
পরদিন নদী স্কুলে যাবার পথে পলাশ তার পথ আটকে কুরুচিপূর্ণ আচরণ করে। নদী ভয়ে ও অপমানে বাড়ি ফিরে যায়। নদীর মা নেই, বাবা ছিলেন দূরে কাজে। প্রতিবাদ করার কেউ ছিল না, আর গ্রামবাসীরাও ভয়ে কিছু বলত না।
অবশেষে সাহস করে নদী থানায় গিয়ে অভিযোগ করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, সেখানেও তাকে অপমান সইতে হয়। পলাশের প্রভাবশালী বাবার কারণে পুলিশও কিছু করে না।
এই খবর পেয়ে ক্ষুব্ধ পলাশ ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্ত নেয়। পরদিন নদী যখন বাড়ি থেকে বের হয়, পলাশ তার মুখে এসিড ছুড়ে মারে।
পড়শিরা দৌড়ে এসে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। নদীর মুখ পুড়ে বিকৃত হয়ে যায়—চেনার উপায় থাকেনা সেই চিরচেনা মুখ।
তবু নদী ভেঙে পড়েনি। দীর্ঘ চিকিৎসা ও সেবার পর, সেও একদিন আয়নায় তাকিয়ে নিজেকে দেখে সাহস খুঁজে নেয়।
সে ঠিক করে—এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সে লড়বে। সে হয়ে ওঠে এক এসিড-আক্রমণ থেকে বেঁচে-ফেরা যোদ্ধা।
নদী পরে বিভিন্ন সংগঠনের সহায়তায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে এবং নারী নির্যাতন বিরোধী এক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়। আজ সে শুধুই একটা নাম নয়—একটা প্রেরণা, সাহস আর প্রতিবাদের প্রতীক।
নদীর গল্প আমাদের শেখায়—নীরব থাকলে অন্যায় বাড়ে, কিন্তু সাহস করে দাঁড়ালে অন্যায়ই একদিন হার মানে। মুখ পুড়লেও স্বপ্ন পোড়ে না। জীবন যতই কঠিন হোক, লড়াই চালিয়ে গেলে আলো একদিন ঠিকই দেখা যায়।