Posts

প্রবন্ধ

"যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে, তা আছে দেহভাণ্ডে" — একটি দার্শনিক বিশ্লেষণ

June 4, 2025

মোঃ আব্দুল আউয়াল

Original Author অধ্যক্ষ এমএ আউয়াল

132
View

“যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে, তা আছে দেহভাণ্ডে”—এই আপাত সরল বাণীটির মধ্যে নিহিত রয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশের আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক চেতনার এক গভীর অভিমত। এটি শুধু একটি বচন নয়, বরং মানুষের আত্মোপলব্ধি, যোগচর্চা, তন্ত্র, বাউল দর্শন এবং উপনিষদীয় জ্ঞানের এক সংক্ষিপ্তসার। এই উক্তির মর্মার্থ বোঝার মাধ্যমে আমরা উপলব্ধি করতে পারি, কীভাবে মানবদেহ একটি ক্ষুদ্র অথচ সম্পূর্ণ মহাবিশ্বের প্রতিফলন
১. ব্রহ্মাণ্ড ও দেহভাণ্ড: একটি তুলনামূলক রূপক

‘ব্রহ্মাণ্ড’ বলতে বোঝানো হয় সমগ্র মহাবিশ্বকে—যেখানে আছে অসংখ্য গ্রহ-নক্ষত্র, উপাদান, শক্তি ও সত্তা। আর ‘দেহভাণ্ড’ বোঝায় মানবদেহকে—যা আপাতদৃষ্টিতে সীমিত হলেও এর গভীরে রয়েছে এক পরিপূর্ণতা। দেহকে শুধু শারীরিক কাঠামো হিসেবে না দেখে, যদি চেতনার আধার হিসেবে দেখা হয়, তবে বোঝা যায়, এই দেহেই নিহিত আছে সেই মহাজাগতিক রহস্যের সূক্ষ্ম রূপ।

তাই বলা হয়, দেহ আর ব্রহ্মাণ্ড একে অপরের প্রতিবিম্ব।
২. পঞ্চতত্ত্বের প্রতিফলন

ভারতীয় দর্শন মতে, ব্রহ্মাণ্ড গঠিত হয়েছে পাঁচটি মৌলিক উপাদান—পৃথিবী, জল, অগ্নি, বায়ু ও আকাশ—এই পঞ্চতত্ত্ব দিয়ে। আশ্চর্যের বিষয়, মানবদেহও এই পঞ্চতত্ত্বেই গঠিত।

পৃথিবী: দেহের কঠিন অঙ্গ (হাড়, মাংস ইত্যাদি)

জল: রক্ত, রস ও অন্যান্য তরল পদার্থ

অগ্নি: হজমশক্তি, দৃষ্টিশক্তি, উষ্ণতা

বায়ু: দেহের প্রাণচলাচল, নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস

আকাশ: মনের বিশুদ্ধতা, চিন্তার পরিসর


এই উপাদানগুলো যেমন মহাবিশ্বে কাজ করছে, তেমনই মানুষের শরীরেও কাজ করছে তাদের নিজ নিজ ভূমিকা নিয়ে।
৩. যোগ ও তান্ত্রিক চেতনায় দেহমহাবিশ্ব

যোগদর্শনে বলা হয়, দেহের মধ্যেই রয়েছে চক্র, নাড়ি, এবং কুণ্ডলিনী শক্তি—যার জাগরণে চেতনার পূর্ণতা ঘটে। এই কুণ্ডলিনী শক্তি মুলাধার থেকে শুরু করে সহস্রার চক্র পর্যন্ত উত্থিত হয়ে মানুষের দেহে ঈশ্বরসাধনার পথ তৈরি করে।

তান্ত্রিক দর্শনে দেহই সাধনার ক্ষেত্র। তারা বলে, দেহের প্রতিটি অংশই কোনো না কোনো তত্ত্বের আধার—যেমন, হৃদয় চক্রে প্রেম, কণ্ঠ চক্রে বাকশক্তি, মস্তিষ্কে ধ্যান বা বোধের উৎস ইত্যাদি। দেহের ভিতর দিয়েই তাই মানুষ ব্রহ্মকে উপলব্ধি করতে পারে।

৪. বাউল দর্শনে দেহতত্ত্ব
বাংলার বাউল, সুফি ও বৈষ্ণব সাধকরা দেহতত্ত্বকে আধ্যাত্মিক চর্চার প্রধান কেন্দ্র করে তুলেছিলেন। লালন ফকির বলেছিলেন:

> “যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে, তা আছে এই দেহে।
খুঁজে দেখলে পাবে রে ভাই, অন্তরে।”
বাউলরা বিশ্বাস করতেন, ঈশ্বর বা চিরসত্যকে বাহিরে খুঁজে লাভ নেই। দেহরূপী এই ঘরেই তার বাস। তাই তারা দেহচর্চা, আত্মবিশ্লেষণ, ও মননশীলতার মাধ্যমে চেতনার পরিপূর্ণতা লাভের চেষ্টা করতেন।
৫. উপনিষদীয় চিন্তায় আত্মা ও ব্রহ্ম এক
উপনিষদে বলা হয়েছে—

> “আত্মা ইবম্ সর্বং”, অর্থাৎ “আত্মা সর্বত্র বিরাজমান।”
এখানে আত্মা মানে সেই চৈতন্য, যে চৈতন্য মহাবিশ্বে যেমন বিরাজমান, তেমনি মানুষের অন্তরে। তাই আত্মার উপলব্ধি মানেই ব্রহ্মের উপলব্ধি।
আরও বলা হয়—

> “যঃ পশ্যতি সঃ পশ্যতি” — “যে এই আত্মার মধ্যেই সর্বত্র ব্রহ্মকে দেখে, সেই প্রকৃত দ্রষ্টা।”

এইভাবেই মানবদেহ ও ব্রহ্মাণ্ডকে একই সত্তার দুই রূপ হিসেবে দেখা হয়।

৬. আধুনিক বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা

আধুনিক বিজ্ঞানও আংশিকভাবে এই দর্শনের সঙ্গে সাযুজ্য খুঁজে পেয়েছে। যেমন,

ডিএনএ (DNA) মানবদেহের প্রতিটি কোষে থাকলেও, সেটি সম্পূর্ণ জিনগত তথ্য বহন করে, যা আবার মহাবিশ্বে প্রাণের বিস্তৃত ইতিহাসের অংশ।

কসমিক উপাদান যেমন কার্বন, লোহা, অক্সিজেন—যেগুলো নক্ষত্রে তৈরি—তা-ই আবার আমাদের দেহেও বিদ্যমান।


এই দৃষ্টিকোণ থেকে বলাই যায়—আমরা প্রকৃত অর্থে “স্টারডাস্ট”।
উপসংহার

“যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে, তা আছে দেহভাণ্ডে”—এই কথাটি শুধু কবিতার চিত্রকল্প নয়, এটি এক গভীর আত্মবোধ, দর্শন ও জীবনদর্শনের প্রতীক। এই ভাবনার মাধ্যমে আমরা জানতে পারি, নিজেকে জানা মানেই জগতকে জানা। বাহিরে যতই খুঁজে ফিরি না কেন, আসল সত্য লুকিয়ে থাকে আমাদের ভেতরেই। তাই আত্মজ্ঞানই বিশ্বজ্ঞান।


-

Comments

    Please login to post comment. Login