স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধ একটি সর্বসম্মত ও সর্বজনবিদিত ভিত্তি -যার উপর দাঁড়িয়ে গড়ে উঠেছে জাতির পরিচয়, আত্মমর্যাদা ও রাষ্ট্রীয় নৈতিকতা। অথচ প্রায়ই দেখা যাচ্ছে, খোদ এই ইতিহাসকেই পরিণত করা হচ্ছে হীন রাজনৈতিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মুখপাত্রে। কে মুক্তিযোদ্ধা, আর কার অবদান বাতিলযোগ্য -এ প্রশ্ন আজ কেবল রাষ্ট্রবিজ্ঞান বা ইতিহাসবিদের ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ আলাপ নয়, বরং এটি হয়ে উঠেছে অপরাজনৈতিক কৌশলে আত্মস্বার্থনিমগ্নতার ভয়াল স্মারকলিপি।
১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালির সশস্ত্র প্রতিরোধে জেড ফোর্সের অধিনায়ক ও বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমানকে মুক্তিযুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুই তাঁর হাতে গৌরবময় পদক তুলে দেন। কিন্তু ২০২১ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) তাঁকে দেওয়া ওই খেতাব বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্তটি জনসমক্ষে আসার পর ‘প্রথম আলো’ পত্রিকায় তা লিড নিউজ আকারে প্রকাশিত হয় এবং দেশব্যাপী তুমুল বিতর্ক সৃষ্টি করে। গণমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তরঙ্গ এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে হিসাব-নিকাশের পর শেষ পর্যন্ত মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের পথে এগোতে পারেনি।
কিন্তু ওই বদ ও বানোয়াট ইতিহাসচর্চা থেমে থাকেনি -বরং নতুন রূপে হাজির হয়েছে ২০২৫ সালের ৩ জুন। অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি নিয়ে ফের আসল নীতিগত পুনর্বিন্যাসের বাজে রদবদল। জামুকা আইন-২০২২ সংশোধন করে আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিভাগ যে অধ্যাদেশ জারি করেছে, তাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদসহ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জয়ী চার শতাধিক রাজনৈতিক নেতার মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি বাতিল করা হয়েছে। ওই আইনের ১৫(খ) অনুযায়ী শেখ মুজিব ও তাঁর সতীর্থদেরকে মুজিবনগর সরকারের অংশ -এই ক্যাটাগরিতে ফেলে 'বীর মুক্তিযোদ্ধা' স্বীকৃতি অবনমন করে মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী বলা হয়েছে।
এই সিদ্ধান্ত চরমভাবে বিতর্কিত ও বিভাজনমূলক। ওই নেতারাই ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক নেতৃত্বের চালক, প্রেরণার উৎস ও আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক স্বীকৃতির প্রবল কারিগর। এঁদের স্বীকৃতি বাতিল মানে কেবল ব্যক্তির নয়, ইতিহাসের রেফারেন্স কাঠামোকেই চ্যালেঞ্জ করা হলো।
এই পরিস্থিতি সামনে এনে দেয় একটি বড় প্রশ্ন -রাষ্ট্র কি ইতিহাসের নিরপেক্ষ সংরক্ষক, নাকি ক্ষমতার পালাবদলে ইতিহাসের ভাষ্যকার? মুক্তিযুদ্ধ কি কেবল সামরিক অভ্যুত্থান, নাকি রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি ও জাতীয় ঐক্যের মহাসম্মিলন?
বর্তমান প্রেক্ষাপটে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ের এমনতর হীনস্বার্থগন্ধী রাজনৈতিক ব্যাখ্যার এই বিশ্রী প্রবণতা আমাদের অতীতের ভিত্তিকেই অস্থিতিশীল করে তুলবে। আওয়ামী লীগের নীতির ঘোরতর সমালোচক এবং জুলাই গণ-আন্দোলনের পক্ষভূক্ত রাজনীতি সচেতন ব্যক্তিরাও আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলের এমন কলুষযুক্ত অমাবস্যা নীতির কঠোর সমালোচনা করছেন।
রাজনৈতিক অভিসন্ধি যদি ইতিহাসের মূল্যায়নে প্রবেশ করে, তবে ভবিষ্যতের প্রজন্ম এক টালমাটাল ও বিভ্রান্তিকর ঐতিহাসিক সিলেবাস নিয়ে বড় হবে।
তথ্য ও ভাবনার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়, জামুকার এই সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এটি এক ধরনের আইনি সংস্করণে ইতিহাস রচনা -যেখানে আদর্শ নয়, বরং ক্ষমতা ও প্রয়োজনে ইতিহাসকে যেন নিজেদের মর্জিমাফিক সংকলন করা যায়।
সুতরাং, এই সিদ্ধান্তকে ইতিহাস নয়, অপরাজনৈতিক কৌশল হিসেবে বিশ্লেষণ করাই যুক্তিযুক্ত। যেহেতু ইতিহাস একদিন তার নিজের বিচার নিজেই করে, আজ যে অধ্যাদেশে যাঁদের নাম বাদ, কাল ইতিহাস তাদের নাম মোচনকারীদের কলঙ্ক নিয়েই কঠোর প্রশ্ন তুলবে। সময় তার বদলা নেবে।
শুধু এই একটি কারণেই বর্তমান সরকারের অনেকের পরিণতি পতন হওয়া শেখ হাসিনার চেয়েও ভয়াবহ হবে -এমন আশঙ্কা অমূলক নয়। নিন্দা জানানোর যথোপযুক্ত ভাষা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। প্রতিহিংসা ও ঘৃণার রাজনীতি কখনোই আওয়ামী লীগের জন্য কল্যাণ বয়ে আনেনি; বরং তা তাদের আশা-ভবিষ্যতকে আরও অনিশ্চিত করেছে। একজন বাংলাদেশি ও বাংলা ভাষাভাষী নাগরিক হিসেবে আমরা গভীর বেদনা ও অভিমান থেকে এই অকর্মের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদের আগুন শব্দ উচ্চারণ করছি।
এইদেশে শেখ মুজিব, তাজউদ্দিন, মেজর জিয়া মুক্তিযুদ্ধ না করলে, কার কোন পিতৃপুরুষে করেছে সেটি ভজঘটে ক্ষমতার ফাঁদে পড়া আপনাদেরকেই খোলাসা করতে হবে। জামুকা নামের খামোখা প্রতিষ্ঠানের আর কোনো গণসমর্থন রইল না।
এই যে দেখে নিন, খুব সঙ্গতকারণেই আপনাদেরকে আবারও অভিশাপ দিচ্ছেন কবি শামসুর রাহমান:
অভিশাপ দিচ্ছি ওদের তৃষ্ণায় পানপাত্র প্রতিবার
কানায়-কানায় রক্তে উঠবে ভরে,
যে রক্ত বাংলায় বইয়ে দিয়েছে ওরা হিংস্র জোয়ারের মত।
অভিশাপ দিচ্ছি আকণ্ঠ বিষ্ঠায় ডুবে ওরা অধীর চাইবে
ত্রাণ
অথচ ওদের দিকে কেউ দেবে না কখনো ছুঁড়ে একখন্ড দড়ি।
লেখক: সাংবাদিক
৪ জুন ২০২৫