হঠাৎ ঝড়:-
সাত বছরের আয়মান দৌড়ে এসে মায়ের আঁচলে মুখ গুঁজে ফেলে।
— "আম্মু, আজকে আমি মসজিদে হুজুর সাহেবের সাথে নামাজ পড়েছি!"
মা হেসে মাথায় হাত বুলিয়ে দেন,
— "আলহামদুলিল্লাহ, আমার ছেলেটা কত সুন্দর নামাজ শিখছে!"
সন্ধ্যার আকাশে আজ রঙিন মেঘ ছিল, পাখিরা ফিরছিল বাসায়, চারপাশে ছিল এক চিরচেনা শান্তি। কিন্তু জীবনের সবচেয়ে বড় ঝড় নেমে আসে সব চেয়ে শান্ত মুহূর্তেই।
সেই রাতেই খবর আসে—বাবা-মা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন।
আয়মান তখনো ঠিক বুঝে না "মৃত্যু" মানে কী। লোকজন আসছে, কান্নার শব্দ, জানাজা, দাফন—সবকিছু যেন তার চারপাশে ঘটছে, কিন্তু সে কিছু বুঝতে পারছে না। শুধু জানে—মা আর তাকে কোলে নিচ্ছেন না। বাবা কুরআন তিলাওয়াত করছেন না।
সেই রাতেই সে প্রথমবার একা ঘুমায়, খালি ঘরে, খালি হৃদয়ে।
একাকিত্বের দিন:-
দিন যায়,রাত যায়। সপ্তাহ কিংবা মাস গড়িয়ে যায় । কিন্তু পিতা-মাতার সেই আকস্মিক শূন্যতা আয়মানের অন্তরে যে বিষন্নতার ছাপ লাগিয়ে দিল, তা যেন আর কোনদিনই কেটে যাওয়ার নয়। আত্মীয়রা কয়েকদিন পর যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। কেউ বলে—"দেখার মতো সময় নেই", কেউ বলে—"ওকে মাদ্রাসায় দিয়ে দাও"।
কিন্তু মাদ্রাসায় যাওয়ার আগের কিছু দিন, আয়মান একা একা ঘরে থাকত।ঠিকমতো খাওয়া হতো না, ঘুম আসত না।পিতা-মাত উভয়কে হারানো এই শিশুর যে খোঁজ নিতে হবে, তা যেন আত্মীয়-স্বজনরা ভুলেই গিয়েছিল। মাঝে মাঝে মাথার নিচে মা’র ওড়নার একটা টুকরো রাখত, যা সে লুকিয়ে রেখেছিল।আর এটি যেন তার কষ্টকে আরো দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিত। কিন্তু কি করার? মন তো মানে না। যে ঘরে একদিন সে ছিল মায়ের আদুরে সন্তান। সেই ঘরে তো আজ কেউ তাকে আদর করে না। তাই মায়ের আদরের সেই স্মৃতিগুলো তাকে বারবার পীড়া দিতে থাকে। ফলে সে মমতাময়ী মায়ের স্মৃতিচারণে হারিয়ে যায়।
তবে সে প্রতিদিন ভোরে উঠে নামাজ পড়ত। এটিও যেন ছিল মায়ের স্মৃতিচারণেরই একটি অধ্যায়! কারণ মা তাকে শিখিয়েছিলেন—
" যার কেউ থাকে না, একমাত্র আল্লাহই তার আশ্রয় হন।"
আইমান দিনরাত ভাবতে থাকে এখন তার কি করা উচিত?কিন্তু ভেবে সে কোন কূলকিনারা পায় না! এভাবেই কোন একদিন ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে গেল নিষ্পাপ আয়মান। ঘুমের ঘরে সে দেখতে থাকে, তার মমতাময়ী মা তাকে ডাকছেন। আর বলছেন। "বাবা আজ তুমি পৃথিবীতে অসহায়, তোমার জন্য একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কেউ নেই।তবে তোমার জন্য এখনো একটি জায়গা আছে,"এতিম খানা"। যেখানে জান্নাতি লোকদের বসবাস। যারা দিনরাত আল্লাহর দ্বীনের চর্চা করে। মানুষদেরকে ভালবাসে। দ্বীনের পথে ডাকে। সত্যের আহ্বান করে। এবং সর্বোপরি এতিমদের আগলে রাখে। তারা নিজেরা কষ্টে থাকলেও এতিমদেরকে তারা কষ্টে থাকতে দেয় না। তাই তুমি সেখানে চলে যাও! সেখান থেকে দ্বীন শিখে আমাদের জন্য দোয়া করবে।
হঠাৎ আইমানের ঘুম ভেঙে যায়। সে ভাবতে থাকে, আসলেই তো! আমাকে এভাবে অলস সময় কাটালে হবে না।আমাকে কিছু একটা হতে হবে। পিতা মাতা চলে গিয়েছেন, তাই কি হয়েছে? পৃথিবীতে আমাকে এমন কিছু করতে হবে, যেন পিতা-মাতাসহ আমি একসঙ্গে জান্নাতে বসবাস করতে পারি। তাই সে মনস্থির করে, যত দ্রুত সম্ভব আমাকে মাদ্রাসায় চলে যেতে হবে।
একদিন, গরম দুপুরে পায়ে হেঁটে আয়মান নিজেই পাশের মাদ্রাসায় চলে যায়।
নূরের পথ:-
মাদ্রাসার মোয়াল্লেম হুজুর তার দিকে প্রথমে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন । একটি ছোট ছেলে, ময়লা জামা, চোখে জল, কিন্তু ঠোঁটে কোরআনের আয়াতের উচ্চারণ।
— "তুমি কী চাও, বাবা?"
— "আমি এখানে থেকে কোরআন শিখতে চাই। "
হুজুর মুগ্ধ হন। ওস্তাদদের সঙ্গে কথা বলেন। সিদ্ধান্ত হয়—আয়মান এখানেই থাকবে।
সেই দিন থেকে শুরু হলো নতুন জীবন। ফ্রথমে তার পরনের ময়লা কাপড়গুলো খুলে তার জন্য ভালো পোষাকের ব্যবস্থা করা হলো।সে অন্য ছাত্রদের সঙ্গে ঘুমাত , পড়ত, খেলত না ঠিকই, তবে প্রতিদিন কুরআনের সাথে সময় কাটাত।
প্রথমে সে সূরা ফাতিহা মুখস্ত করে , এরপর সূরা নাস, সূরা ফালাক… একসময় সে পুরো আমপারা মুখস্থ করে ফেলে।
তবুও রাত হলে সে জানালার পাশে বসে থাকত। চোখে তার এক ধরনের আলো, এবং এক ধরনের অভাব।
কিন্তু সে অভাব কারও জন্য নয়—সেটা শুধু মা-বাবার জন্য।যাদের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে সে একদিন বলেছিল,
"আল্লাহ, আমি তোমার সন্তুষ্টি চাই। আমার মা-বাবাকে তুমি জান্নাতে দাও। আমিও তোমার রাস্তা ধরবো।"
আল্লাহর দেয়া মর্যাদা:-
আয়মান বড় হতে থাকে, তাকে সব ছাত্ররা ভালোবাসে। সে কারও সঙ্গে রাগ করে না, সবসময় মুখে বলে "ইনশাআল্লাহ", "আলহামদুলিল্লাহ", "সুবহানাল্লাহ"।
এরই মাঝে দেখতে দেখতে একসময় সে পবিত্র কুরআনে কারীমের হাফেজ হয়ে যায়।
একদিন মাদ্রাসায় ইসলামিক প্রতিযোগিতা হলো। আয়মান তিলাওয়াত করল সূরা মুদ্দাসসির—তার কণ্ঠে ছিল কান্নার সুর, তার চোখে ছিল সত্যতা। পুরো মসজিদে নীরবতা নেমে আসে।
বিচারকরা দাঁড়িয়ে যান। এক বৃদ্ধ বিচারক বলে ফেলেন—
"এই ছেলে আল্লাহর রহমতের ফল।"
সেই দিন থেকে তাকে ‘হিফজ বিভাগ’-এর শিক্ষক বানানো হয়, অন্য এতিমদের কোরআন শেখানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়। এভাবেই যুগে যুগে যারা আল্লাহর রহমতের আশাবাদী হয়ে জীবন পরিচালনা করেছে,আল্লাহর রহমতে তাদের জীবনের সফলতা শিখিয়েছে।
এতিমের দোয়া:-
আয়মান এখন ১২ বছরের ছেলে, কুরআনের হাফেজ, একজন ছাত্র, একজন শিক্ষক। সে প্রতিদিন সকালে সবার আগে উঠে তাহাজ্জুদের
চার রাকাত সালাত আদায় করে।
এখনো তার দোয়া একটাই:
"হে আল্লাহ, আমার মা-বাবাকে তুমি জান্নাতে রাখো। আমাকে তাদের সাথে মিলিয়ে দিও—তোমার সন্তুষ্টি নিয়ে। আর আমাকে এমন বানাও, যাতে আমি কোনো এতিম শিশুর চোখে আবার আশার আলো জ্বালাতে পারি।"
তাইতো বলা হয়, যে কষ্ট পায়, সে কষ্টের মর্যাদা বুঝে।
শেষ কথা:-
আয়মানের মতো এতিমেরা দুনিয়ায় একাকী জন্ম নেয় না, তারা আল্লাহর নির্দিষ্ট পরিকল্পনার অংশ। আল্লাহ কাউকে ফেলে দেন না। যারা কাঁদে, একা ঘুমায়, যারা খাবার না পেয়ে দু’হাত তুলে ডাকে—আল্লাহ তাদের ডাক দ্রুত শুনে ফেলেন।
আয়মান জানে—এই দুনিয়া ক্ষণিকের, জান্নাতেই সে আবার তার আম্মুকে জড়িয়ে ধরবে, আর বাবার পাশে বসে কুরআন তিলাওয়াত করবে। তাই কীভাবে জান্নাতি হওয়া যায়, সে পথটিই আয়মান বেঁছে নিয়েছে।