Posts

উপন্যাস

রুনা লায়লার সুর ও কিংবদন্তি অবলম্বনে গীতি-উপন্যাস "মায়ার সিংহাসন"- ১

June 5, 2025

আব্দুল্লাহ আল মুক্তাদির

582
View
অলংকরণ: রাজীব দত্ত

পর্ব-১: কাহিনীর মতো মনে হয় 

মানুষ হয়ে জন্মানোর সবচেয়ে বড় যন্ত্রণা হলো, আমাদের পরম আনন্দ আর চরম দুঃখের উৎস প্রায় প্রতিটা সময় এক এবং অনিবার্য। যে প্রিয় মুখ প্রিয় কণ্ঠ আমাদের বুকভাঙা পিপাসাগুলোকে দূরে ঠেলে দেয়, সেই স্বর সেই চোখের আড়ালেই জ্বলতে থাকে বিরহের তীব্র আগুন। 

বিরহ নামের অগ্নিগিরির সাথে আমার পরিচয় অতি অল্প বয়সে, যখন এমনকি পনেরোও পার হই নাই। বলতে গেলে প্রেম আদতে কী তা আমাকে বুঝতে হয়েছে বিরহের আজব শাস্তি ভোগের পর। সেই মন ঘায়েল করা দিনগুলোতে নিজেকে প্রায়ই উদ্বায়ী মনে হতো। যেন কেবল বরফ হয়ে বাঁচতে হবে। গলতে পারবো না কোনো রোদে, উত্তাপে। আর ঝড় হলে তৎক্ষণাৎ মৃত্যু। সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকতাম এই বোধহয় পদ্মা থেকে বাতাস উঠে আসলো। আমার কর্পূর মন উড়িয়ে নিয়ে দমকা হাওয়া এখনই কোন এক অদেখা সমুদ্রে ফেলে আসবে! কিন্তু আমাকে গলতে হয়েছিল মোমের চেয়েও দ্রুত। নিজেকে অবাক করে দিয়ে আমার মনের সুগন্ধ শরীর গলে ঝরে পড়েছিল বৃষ্টি শেষের জল হয়ে, শহরের অলিতে গলিতে। রাজশাহী শহরে তখনও বাড়িতে বাড়িতে মাটির চুলায় রান্না চলে। বিকেলগুলো ঝাপসা হয়ে যায় মশলা-গন্ধি ধোঁয়ায়।  

আজকেও আমাদের হোস্টেলের দক্ষিণ আকাশ ঢেকে গেছে। উত্তর দিকের ছবি যদিও কিছুটা পরিষ্কার, বেশিক্ষণ থাকবে বলে মনে হচ্ছে না। তার ট্রেন এসে পৌঁছানোর কথা রাতে। ততক্ষণে বৃষ্টি নামার সম্ভাবনা প্রচণ্ড। ঠিক করলাম আগেভাগেই চলে যাবো স্টেশনে। একটা রিকশা নিলাম প্রথমে সাহেব বাজার পর্যন্ত। প্রিয় মেহমানের জন্যে কিনলাম, “যে জলে আগুন জ্বলে”। অলকা হল পর্যন্ত কোনো কারণ ছাড়া দুই তিন বার হাঁটলাম। এরপর ঢুকে পড়লাম গীতাঞ্জলিতে, রাজশাহীতে তখন পর্যন্ত আমার সবচেয়ে প্রিয় দোকান। লম্বা ঘরের দুই পাশে হাজার হাজার ক্যাসেট সিডি। মাঝখানে নকশা কাটা কাঠের টেবিলে সাজানো থাকে আরও অন্তত কয়েকশ অ্যালবাম। 

ঢুকতেই চোখ গিয়ে পড়লো সোজা পুলিশের ইউনিফর্মের উপর। দুইজন সটান দাঁড়িয়ে আছে একেবারে পুবের দেয়াল ঘেষে। তৃতীয় ব্যক্তি বড়ো কোনো অফিসার হবে নিশ্চয়ই। হাতে একটা সিডি, আরও কয়েকটা বক্স-খোলা কাভার সামনে পড়ে আছে। তাঁর গম্ভীর কণ্ঠস্বর শুনে হঠাৎ করেই আমার বুক কেঁপে উঠল। আমি যতোদূর জানি, নগর পুলিশের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি তিনি। ঘাড় ঘুরালে হয়তো আমাকে চিনেও ফেলবেন। না চিনলেই ভালো। সেই ভয়জাগানিয়া রাতের স্মৃতি আমি আর মনে করতে চাই না। আমি বরং সোজা নিউ মার্কেট চলে যাই। ওখানকার দোতলার দোকানটাও খারাপ না। গীতাঞ্জলির মতো পরিসর এতো বিশাল না হলেও, আমি যে দুইটা ক্যাসেট খুঁজছি সেগুলো মোটামুটি জনপ্রিয়,  ওখানেও নিশ্চিত পাওয়া যাবে।

আবার হাঁটতে শুরু করলাম। মাথার মধ্যে থেকে পুলিশের আগুন চোখ, বুটের শব্দ আর তাক করা বন্দুকের ছবি কিছুতেই সরাতে পারছি না। আমাদের সবার সেদিন গলা শুকিয়ে কাঠ।  আচমকা জেরার মুখে পড়ে কেউই কোনো বাক্য শেষ করতে পারছিলাম না। অগোছালো, ভাঙা বাংলায় আমাদের উত্তরগুলো নিজেদের কানেই কেমন উদ্ভট শোনাচ্ছিল।

নিউ মার্কেটে আমি সবসময় দক্ষিণদিকের গেইট দিয়ে ঢুকি। ডানপাশের চায়ের দোকানটা মারাত্মক টানে আমাকে। এতো আয়েশ করে এই মামা চা বানায়, আর এমন সুগন্ধ উঠে আসে সাদা কাপ হাতে নেওয়ার সাথে সাথে! আজকে চায়ের কথা বলে দোতলায় উঠে গেলাম এক দৌড়ে। দোকানে খুব একটা ভিড় নাই। এখানকার একটা সুবিধা হলো ঘুরে ঘুরে হাতে নিয়ে ক্যাসেট দেখা যায়। দামও অন্যদের তুলনায় কম রাখে। আজকে সময় কম দেখে আর ভিতরে গেলাম না। অ্যালবামগুলো কোনোরকম ব্যাগে নিয়ে সোজা নেমে এলাম। 

রাজশাহী স্টেশনের নতুন ভবন এখনও নির্মাণাধীন। পুরোনো প্ল্যাটফর্মে কোনো বসার জায়গা না পেয়ে বাস টার্মিনালের দিকের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ালাম মিনিট দশেক। এরই মধ্যে কোলাহল, হুইসেল।  ট্রেনে ওঠার আগে একবার মাত্র কথা হয়েছে ওর সাথে। নিজের ফোন নাই, তাই পরের আর কোনো আপডেট জানাতে পারে নাই। কোন বগি জানিনা।  বুদ্ধি করে, নামার পরে যে লোকটা যাত্রীদের টিকেট চেক করে তার পাশে গিয়ে চোখ কান খুলে রেখে দাঁড়ালাম, কিন্তু ভাবতে শুরু করলাম একেবারে অন্য কিছু। সম্পূর্ণ ভিন্ন বাতাসের ঘ্রাণ এসে বিঁধল আমার নাকে।

কাহিনীর মতো মনে হয় 

আমি এক প্রেয়সী, তুমি প্রেমময়

হৃদয়ের এ আকুলতা

জীবনের এ মুখরতা

যায় না বেঁধে রাখা যায় না

আজকে আমাদের মাত্র তৃতীয়বার দেখা হবে পুরো জীবনে। এবং প্রেমে পড়ার পর আজকেই প্রথম। এক মহাবিপদের সামনে দাঁড়িয়ে তার সাথে আমার পরিচয়। স্মরণ কালের সবচেয়ে বিনাশী নদীভাঙন।  যমুনার হা করা খোলা মু্খে সাদা-বেগুনি জর্জেটের ওড়না উড়িয়ে সে দাঁড়িয়ে ছিল একেবারে আমার নাক বরাবর। আমার কাঁধে তখনও ব্যাগ। আগের দিন সকাল দশটায় রওনা দিয়ে এসে পৌঁছালাম অন্তত বাইশ ঘণ্টা পর। মনে করেছিলাম জন্মভিটার এক টুকরো মাটিও আর দেখতে পাবো না।  সবচেয়ে আপন ঠিকানা হারানোর শোক সহ্য করার প্রস্তুতিও নিচ্ছিলাম দীর্ঘ রেলযাত্রার প্রতি শব্দ, প্রতি পদক্ষেপে। কিন্তু এসে যা দেখলাম, তার লৌকিক ব্যাখ্যা আমি এখনও খুঁজে পাই নাই। এক মহা বিস্ময় সেদিন আমাকে এনে বালুর মতো ছড়িয়ে দিয়েছিল ভয়াল যমুনার সদ্যশান্ত কূলে। 

শেষ রাতে নদী থেমে গেছে। দাদি চোখে জল, মুখে হাসি নিয়ে যাকে সামনে পাচ্ছে তাকেই গলগল করে বলে যাচ্ছে বিরানব্বই সালের ভাদ্র মাসের গল্প। সেই গল্পের মূল চরিত্র অবশ্যই যমুনা। কিন্তু দাদি বারবার আটকে যাচ্ছে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর শাড়ি, চুল, রূপে। এবার যদিও কোন প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রী আসে নাই, এমনকি ভাঙন আটকানোর কোন সরকারি চেষ্টাও ছিল না মনে রাখার মতো, রহস্যময় যমুনা তারপরও ঠিকই সমান কায়দায় থেমে গেল। সারা গ্রামে, ঘর থেকে ঘরে আনন্দ ছড়াচ্ছে দ্রুত। আবার মিহি একটা ভয়ের রেশও রয়ে গেছে। বাবার গলা প্রত্যেক বাক্যে কয়েকবার করে আটকে যাচ্ছে। মা টানা বসে আছে জায়নামাজে, ফজরের পর শুনলাম আর ওঠেন নাই।

কেটে কাঠ করে ফেলা হয়েছে গ্রামের সবচেয়ে প্রাচীন নিমগাছটাকে। পুকুরের ঢালে ছড়িয়ে আছে তাজা পাতা, ভাঙা ডাল। গোরস্থানের দিকে তাকিয়ে আরো উদাস হয়ে যেতে বাধ্য হলাম। পাকা কবর টিকে আছে কেবল একটা, সত্যি বলতে গেলে অর্ধেকেরও কম।  গ্রামটাও বেঁচে আছে অর্ধেক হয়ে। আমাদের বাড়ি থেকে নিচু একটা মাটির রাস্তা ধরে সোজা পুরোনো বাঁধ পর্যন্ত যাওয়া যেতো। একটা পরত্যিক্ত ডোবার মতো ছিল। তার উপর বিশাল ডালপালা মেলে প্রাচীন একটা গাবগাছ দাঁড়িয়ে। আশেপাশে কোথাও এর চেয়ে বড় গাছ আর ছিল না। বছরের একটা সময়, চৈত্র-বৈশাখে, আমাদের পুকুরটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যেতো। বাঁধের ওইপারে তখনও পানি-টলটল নদী। আমরা দলবেঁধে যেতাম গোসল করতে। আসার পথে সেই গাছের নিচে থেমে যেতাম।  ভরদুপুরে এবং সন্ধ্যার পরে বড়রাও কেউ একলা যেতে সাহস করত না গাছটার আশেপাশে। আমাদের মনেও ছিল ভূতের ভয়। ভীত কোমল হাতে আমরা ফুল কুড়াতাম। এতো এতো ফুল পড়ে থাকত যে মাটি দেখা যেতো না। কিন্তু একটাও ফল আসে নাই কখনও। সবাই বলত এই গাছে একটা মেয়ে ভূতের বাস। আর গাছটা বন্ধ্যা পুরুষ।   

আশ্চর্য নাটকীয়তায় থেমে যাওয়া ভাঙনের মুখে দাঁড়িয়ে আমি নাই হয়ে যাওয়া বাকি গ্রামের ছবি ঝালিয়ে নিচ্ছিলাম। সেই টানা রঙিন ছবির একটা টুকরাও আমি ভুলে যেতে চাই না। এই গ্রামের কেউই হয়তো চায় না। তাই ঠিক যেখানে এসে নদীর ভাঙন থেমে গেছে, সেখানে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে একের পর এক গ্রামবাসী। তারপর পুবদিকে আঙুল তুলে— কখনও একে অন্যকে, কখনও নিজেই নিজেকে— দেখাচ্ছে কোথায় কার বাড়ি ছিল, কেমন পথ ছিল, কতগুলো বাঁশঝাড়, কয়টা জলাশয় ছিল। সম্পূর্ণ গ্রামের শেষ মাথায় উঁচু বাঁধের কথা আমাদের স্পষ্ট মনে আছে। বাঁধের উপর কয়টা দোকান ছিল, কার দোকানে কী পাওয়া যেতো। পশ্চিমে ছিল প্রাইমারি স্কুলের একতলা দালান। সামনে সবুজ মাঠ। আমরা অবাক হয়ে বড়দের কাছে জানতে চাইতাম যমুনা নদীর হাত থেকে রক্ষার জন্যে যে বাঁধ, তার নাম ‘ব্রহ্মপুত্র বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধ’ কেন— তেমন সদুত্তর পেতাম না।

সেই সকালে, সবার আগে দেখলাম তার ঘন খোলা চুল। নরম রোদের সাথে তাল মিলিয়ে উড়ছে বেগুনি ওড়না। রিমলেস চশমা চোখে যখন ঘুরে তাকালো, সহজ সাধারণ মুখটা দেখতে পেলাম শুধু এক ঝলক।  

কথা বলার সাহস সঞ্চয় করতে আমার কিছুটা সময় লাগলো। তাঁর সব উত্তরও আসছিল এক দুই শব্দে। এই গ্রামে আজকেই তার প্রথম আসা, আর সে ঠিক নির্দিষ্ট কারও মেহমান না। মলিন মুখে সুখের হাসি ঝরাতে গিয়ে হঠাৎ থেমে গেল সে। আর আমার মনে পড়ে গেল কাঁধে এখনো ব্যাগ। চোখ মুখ শরীর দীর্ঘ ভ্রমণের ক্লান্তিতে তলিয়ে যাচ্ছে। ঘরে ঢুকে কিছু না খেয়ে, ময়লা কাপড়েই সোজা বিছানায়। দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে দ্রুত ঘুমিয়ে গেলাম। 

স্বপ্নের মত লাগে সব

প্রিয়, তুমি নিয়ে এলে এ কী উৎসব

মায়া-ভরা এ লগন

মধুময় এ স্বপন

জীবনের সাথী হয়ে থাকনা

প্রথম দেখার ঘোর এমন সর্বনাশা! গতমাসে তো এইসব ভাবতে বসে পদার্থবিদ্যার ব্যবহারিক পরীক্ষা মিস করলাম। সরকারি কলেজ তাই পরে তেমন ঝামেলা করে নাই। আজকেও কি আরেকটা অঘটন ঘটে গেল সেই স্মৃতির জাবর কাটতে গিয়ে? সব যাত্রীতো মনে হচ্ছে এরই মধ্যে টিকেট জমা দিয়ে পার হয়ে গেছে মূল ফটক। কিন্তু সে কই? মধ্য কার্তিকের রাত, তাই বলেছিল গায়ে খয়েরি চাদর জড়ানো থাকবে। চোখে পড়েছিল কোনো খয়েরি রঙ? মনে তো হয় না। স্টেশন থেকে বের হতে হতে সম্ভাব্য সব জায়গা খুঁজলাম। বুকস্টলের সামনে একটা খোলা চুলের মেয়েকে দেখে ডাক দিয়ে হতাশ হলাম। সামনে তখনও কিছু যাত্রী রিকশা ঠিক করছিল, তাদের ভিড়েও সে নাই। 

অপেক্ষার অসহ্য অনুভূতি সরিয়ে মগজে জমতে শুরু করলো প্রচণ্ড ভয়। একলা কোথাও হারিয়ে গেল না তো? ট্রেনে বা স্টেশনে কোনো বিপদ, কোনো ক্ষতি? দেখা করতে আসার কথা  আমাদের দুইজনের বাইরে জানে কেবল আমার খালাতো বোন, ইউনিভার্সিটিতে আইন পড়ে। বিনোদপুরে সেই বোনের মেসেই ওকে রেখে আসার কথা ছিল আজকে রাতে। ফেরার সময় রিকশায় বসে এতো কাঁপছিলাম! এগারোটার পর থেকে ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। আমার জলপাই জ্যাকেটেরও বুক খোলা। তুলনাহীন উদ্বেগ আর নতুন প্রেম হারিয়ে ফেলার আশঙ্কার মধ্যেই আবার সেই পুলিশি রাত মনে পড়ে গেল। 

এবং দোষটা শতভাগ আমার ছিল। 


চলবে…
 

Comments

    Please login to post comment. Login

  • Kazi Eshita 3 months ago

    ভালোই লাগলো, বাকিগুলো পড়ে দেখি