শিলং-রোডের প্রথম ভোর
ঢাকার ব্যস্ততা পিছে ফেলে তামাবিল সীমান্ত পেরিয়ে যখন শিলং-রোড ধরা পড়ল, আকাশ তখন তামাটে। দূরে পাহাড়ের কিনারে মেঘেরা সারি ধরে দাঁড়িয়ে, যেন ভোরের মঞ্চে তাদের নীরব রিহার্সাল চলছে। বাসের কাচের জানালা খুলে দম নিতেই টের পেলাম—এই বাতাসের ঘ্রাণে অপরিচিত সবুজের আর্দ্রতা আছে, যা শহরের ধূসর হাওয়ায় মেলে না।
পরদিন দুপুরে পৌঁছালাম মাওলিন্নং-এ। বাঁশের বাড়ির দাওয়ায় পা রাখতেই ছোট্ট এক টোকাই ছেলেকে দেখা গেল রাস্তার ধুলা ঝাড়ু দিচ্ছে। এখানকার বাসিন্দারা ‘কুকি’ গাছের পাতা দিয়ে নিজেদের ময়লা সাজিয়ে রাখে, পরে সার বানায়; প্লাস্টিক তাই বিরল অতিথি। বিকেলে বাতাসে সুগন্ধি গোলপাতার ধোঁয়া ভাসতে থাকল, আর গ্রামবাসীরা বাঁশের সেতুর ওপর বসে ‘জুসেটং’ (স্থানীয় চালের রুটি) আর ‘বামবু শুট কারি’ দিয়ে আমাদের অভ্যর্থনা করল—অভ্রান্ত হাসি তাদের প্রথম ভাষা।
দাউকি পৌঁছে বোঝা গেল ছবির মতো নীল-সবুজ বলতে যা বোঝায়, তার সঙ্গে নদীর পানির কোনো আপস নেই। নৌকা এগোচ্ছে, আর নিচে পাথরের ছোপছোপ নকশা স্পষ্ট—এ যেন জলের ওপরে ভেসে থাকা কাচের পাত। মাঝি লরেন্স মৃদু হেসে বললেন, “এখানে নৌকা চালাতে প্রথম শিখতে হয় নীরবতা, যাতে নদী ভাঙে না।” শব্দহীন ঘুরে দেখলাম ভারত-বাংলাদেশের সীমান্ত রেখা—কোনো বোড়া নেই, অথচ জলের ভেতর এক অদৃশ্য কুহক।
চেরাপুঞ্জিতে ঢুকতেই বৃষ্টি আমাদের তালিম নিতে ডাকল। একেকটা বর্ষাবিন্দু ঘাসে পড়ে ঝংকার তোলে, ঝিরঝিরে ধারায় পাহাড়ি ঝরনা বানাতে বানাতে। নঙথিয়াং জলপ্রপাতের ধারে দাঁড়িয়ে দেখলাম—আলোর রোদের ভেতর সাত রঙের রেইনবো পাখা মেলেছে। গাইড লিংডো বললেন, “এখানে রংধনুই বৃষ্টি শেখায়, আর পাহাড় গায়।” রাতে হোমস্টের চালের চালচিত্রে টিনের ছাদের তালে ঘুম এল; বৃষ্টির বেহালা তখনও বাজছে।
ষষ্ঠ দিনে ৩,৫০০ ধাপ নেমে ‘ডাবিবাস সিঁড়ি’ পেরিয়ে পৌঁছালাম রাবা গ্রামের জীবন্ত মূল-সেতুর কাছে। প্রাচীন রবার গাছের শিকড় চোখের সামনে দশকের পর দশক জুড়ে বোনা হয়ে সেতু বানিয়েছে। জলের ঢেউয়ের মধ্যে পা রাখতেই যেন জেনে গেলাম—মানুষের ধৈর্য আর প্রকৃতির ধালাই মিলে অতীতকে সেতুতে রূপ দেয়, যা কঙ্কালসার বইয়ের পাতায় লেখা থাকে না।
সন্ধ্যায় লাইটলেজের ক্লিফ-টপে উঠতে যখন ক্লান্তি পা দু’টোকে গুঁড়ো করে ফেলছিল, মেঘের ওপরে হঠাৎ চাঁদ উঠল—রূপালি পয়সার মতো। নিচে গহীন অন্ধকারে মেঘেরা সিঁড়ি বেয়ে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। মনে হল, মেঘেরা আমাদের ক্লান্ত পা-দু’টো নিজের পুঞ্জে ঢাকতে চায়, যেন বলে—“একা নও, এই পাহাড়ও ক্লান্তির গল্প জানে।”
সপ্তম দিনে শিলং থেকে ফেরার পথে বাসের জানালায় ভোরের আলো পড়ল। পাহাড়, মেঘ, নদী—সব পিছিয়ে যাচ্ছে, অথচ মনে হচ্ছিল তারা ভেতরে ঢুকে স্থির হয়ে গেছে। ফোনে তোলা ছবিগুলো দেখার থেকেও তীব্র ছিল সেই অদৃশ্য ফিল্ম—যেখানে দাউকির কাচের জল, মূল-সেতুর নীরব শিকড়, আর বৃষ্টির সারেঙ্গি বাজছে একসঙ্গে। রাজধানীর কোলাহলে নেমে যখন প্রথম গাড়ির হর্ন কানে এলো, বুঝলাম—ভ্রমণ শেষ হয় ঠিকই, কিন্তু গল্প থেকে যায়; আর গল্পই মূলত ফিরে যাওয়ার আয়োজন।