Posts

গল্প

একটি চেতনানাশক রুমাল

June 8, 2025

উত্তম চক্রবর্তী

71
View

রাত তখন প্রায় ১১টা ছুঁইছুঁই। গাবতলীর পাশের রাস্তায় নিঃসঙ্গ বাতির নিচে পড়ে আছে ঢাকার সন্ধ্যার ক্লান্তি। দোকানের হিসেব শেষ করে ফিরছিল রায়েদ ও তার সহকর্মী আরিফ। দিনের পর দিন এই একই রুটিন- তারা দুজনেই চিকিৎসক এবং এই শহরের ভিড়ে অসুস্থ কাউকে দেখে এড়িয়ে যাওয়ার মানুষ তারা নয়।

ফেরার সময় হঠাৎ দূরে চোখে পড়ে-রাস্তার ওপাশে এক মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি হঠাৎ মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। কোনো দ্বিধা ছাড়াই তারা দৌড়ে গেলেন তার দিকে।

রায়েদ সঙ্গে সঙ্গে বুঝে ফেললেন- হাইপোগ্লাইসেমিয়া হতে পারে। পকেট থেকে গ্লুকোজ ট্যাবলেট বের করলেন, আরিফ দোকান থেকে দ্রুত একটি ফলের জুস নিয়ে এলেন। মাথায় পানি ঢাললেন, শরীর ঠান্ডা করলেন।

লোকটির চোখ আধবোজা, ঠোঁট নড়ছে-

সিএনজি... ল্যাপটপ... ফোন...

তারা বুঝলেন, কিছু একটা ঘটেছে। কলম ও খাতা এগিয়ে দিতেই কাঁপা হাতে তিনি লিখলেন-

CNG ড্রাইভার আর একজন লোক নাকে রুমাল চেপে ধরেছিল। আমার ফোন ও ল্যাপটপ নিয়ে গেছে।

রায়েদ থমকে গেলেন। মেডিকেলের ছাত্র থাকাকালীন তিনি যেসব ক্রিমিনাল পয়জনিং পড়েছেন, তার মধ্যে অন্যতম ছিল- Stupefying Poisoning। এমন বিষ যা মানুষকে ধীরে ধীরে অচেতন করে ফেলে, স্মৃতি অস্পষ্ট করে দেয়। চেতনা ফিরে পেলেও শরীর আর সাড়া দেয় না।

লোকটি নিজের নাম বলেন- মিনহাজ ইমতিয়াজ। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক। আজ বিকেলে তার বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে তিনি হন্তদন্ত হয়ে বাসা থেকে বের হন। কল্যাণপুর থেকে একটি সিএনজি নিয়ে শাহজালাল এয়ারপোর্টের দিকে যাচ্ছিলেন, বড় ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করার উদ্দেশ্যে।

তিনি বলেন,

রাস্তায় যেতে যেতে সিএনজি থেমে যায়। ড্রাইভার বলে গ্যাস কমে গেছে। এই সময়েই একজন লোক উঠে পড়ে, বলে, ভাই একটু বসতে দেন, কাছেই নামব। হঠাৎ দেখি ওরা দু’জন আমার নাকে একটা ভেজা কাপড় চেপে ধরল... তারপর আর কিছু মনে নেই।

হুঁশ ফেরে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার গেটের কাছে। ড্রাইভার তখন বলে-

আপনার ব্যাগ ওই তো পড়ে আছে। কিন্তু বাস্তবে কিছুই ছিল না।

তিনি কেবল ৫–৬ কদম হাঁটার পরেই মুখ থুবড়ে পড়ে যান।

রায়েদ আর আরিফ বিস্ময়ে একে অপরের দিকে তাকান। কেউ একজন মৃত্যুর সংবাদে পরিবারের কাছে যেতে চেয়েছিল- আর এই শহর তাকে উপহার দিল লুট, বিষ, আতঙ্ক। আরিফ ফিসফিস করে বলল,

ভাই, ভাবুন তো যদি উনি একজন নারী হতেন? এই কাপুরুষ লোকগুলো তখন কী করত?

এই চিন্তাতেই গা শিউরে ওঠে তাদের। সমাজ যতটা প্রযুক্তি ও বুদ্ধিতে এগিয়েছে, নৈতিকতায় যেন ততটাই পিছিয়েছে।

লোকটি নিজের বাসার নাম্বার দিলেন, কিন্তু সেখানে কল করে কেউ ধরল না। হয়তো বাবার মৃত্যুর খবরে পরিবারে চলছে দিশেহারা অবস্থা।

রায়েদ বললেন,

ভাই, আপনাকে এক্ষুনি বাসে তুলে দিচ্ছি। সময় নষ্ট করার সুযোগ নেই।

তারা পাশের একটি বাইকে তুলে নিকটবর্তী মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডে নিয়ে গেলেন মিনহাজকে। একটি ময়মনসিংহগামী বাসে তুলে দিয়ে ড্রাইভারকে অনুরোধ করলেন যেন গন্তব্যে পৌঁছানো পর্যন্ত লোকটিকে নজরে রাখেন।

চোখে পানি নিয়ে মিনহাজ বলেন-

ভাই, আপনারা না থাকলে আজ হয়তো সড়কের এক পাশে নিঃশব্দ লাশ হয়ে থাকতাম। বাবার লাশের পাশে হয়তো কেউ পৌঁছাতই না।

বাসটি দূরে মিলিয়ে যায় রাতের আঁধারে।
রায়েদ আর আরিফ দাঁড়িয়ে থাকেন অনেকক্ষণ। তাদের চারপাশে রাত, নিঃশব্দ অথচ মনজুড়ে এক কঠিন প্রশ্ন- এই শহর কি এখন আর নিরাপদ নয়?

এই ঘটনার পরদিন, রায়েদ তার সামাজিক মাধ্যমে একটি লেখা দেন-

মানুষ তার প্রয়োজনের চেয়ে নীচে নামতে পারলে, সে পশুত্বকেও হার মানায়। আজ তিনি পুরুষ বলেই বেঁচে ফিরলেন। একজন নারী হলে... আমি আর ভাবতেও পারছি না।

সতর্কতা কখনোই দুর্ভাগ্য আনেনা বরং রক্ষা করে এক অনিশ্চিত বিপদ থেকে।
অপরিচিত পরিবহন ব্যবহার করার আগে নিজের নিরাপত্তার কথা ভাবুন। রাতের যাত্রায় একা বের হবেন না। প্রয়োজনে পরিচিত রাইড-শেয়ার সার্ভিস ব্যবহার করুন।

তাং- ০৮/০৬/২০২৫ ইং

Comments

    Please login to post comment. Login