গ্রামের এক কোণায় জন্মেছিল রমা—একটি সাধারণ, চঞ্চল মেয়ে। তখন বয়স মাত্র আট, ঠিক তখনই সাপের কামড়ে বাবাকে হারায় সে। যেই বয়সে শিশুরা ধীরে ধীরে জগতকে চিনতে শেখে, রমা তখন শিখে গেল শোক, শূন্যতা আর অবিচারের প্রথম পাঠ।
বাবার মৃত্যুর পরদিনেই তার ঠাকুমা আর কাকা মা-মেয়েকে ঘরছাড়া করে। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে কেঁদে কেঁদে অনুনয় করেছিল তার মা—“একটু থাকতে দাও, মাথা গুঁজার ঠাঁই দাও”—কিন্তু সেদিন বাড়ির প্রতিটি ইট যেন হয়ে উঠেছিল পাথর, আর মানুষগুলোও তেমনি।
মা আর মেয়ে কোথায় যাবে কিছুই জানত না। নিরুপায় হয়ে রমার মা ভাইয়ের বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। কিন্তু সে ঘরও বড় নির্মম। ভাইয়ের বউ লক্ষ্মী—নামে লক্ষ্মী হলেও, কাজে যেন অলক্ষ্মী। তার মনে আগুন, চোখে বিদ্বেষ। কারণ একটাই—রমার মায়ের বিয়ে হয়েছিল বড় ঘরে, আর সেই হীনম্মন্যতা লক্ষ্মীর মনে জ্বলে ওঠে ঘৃণার আগুনে।
ভাই বারবার অনুরোধ করে বলে, “দিদি আমার রক্তের সম্পর্ক, দয়া করে কিছুদিন থাকতে দাও।” অবশেষে লক্ষ্মী মুখে হাসি এনে অনুমতি দেয়, কিন্তু সেই হাসির নিচে লুকিয়ে ছিল অবজ্ঞা আর প্রতিহিংসা।
রমার মা হয়ে যায় এই বাড়ির কাজের লোক। ভোরে উঠেই রান্না, ঝাড়ু, কাপড় ধোয়া—সব কিছুতেই ব্যস্ত, অথচ দুইবেলা পেট ভরে খাওয়ারও জোগাড় নেই। রমা স্কুলে যায় ঠিকই, কিন্তু সন্ধ্যার পর আলো নিভে গেলে চুপিচুপি কুপি বাতির নিচে পড়াশোনা করে। বুকের ভিতরে একটাই স্বপ্ন—একদিন পড়াশোনা করে মা’কে এই গৃহদাসত্ব থেকে মুক্ত করবে।
এইভাবে কেটে যায় সাতটি বছর। রমা এখন ১৫ বছরের কিশোরী। চোখে আগুনের মতো জেদ, হৃদয়ে অদ্ভুত সাহস। গ্রামের সবাই তাকে চেনে—কখনও কারো অসুস্থ গরু দেখতে ছুটে যায়, কখনও কারো মেয়ের পড়াশোনার খাতা ঠিক করে দেয়। নিজের কষ্টের কথা গিলে নিয়ে সে হয়ে উঠেছে অন্যের আশ্রয়।
একদিন হঠাৎ রমার জীবনে বাজ পড়ে। মামি লক্ষ্মী, কাউকে কিছু না জানিয়ে রমার বিয়ে ঠিক করে দেয় পাশের গ্রামের এক ৩০ বছরের যুবকের সঙ্গে। কারণ সে জানে, বিয়ে দিয়ে মেয়েকে বিদায় করে দিলে বাড়ির বোঝা হালকা হবে।
রমা সব শুনে স্তব্ধ। তার কিশোর মনটা যেন বিদ্রোহে ফেটে পড়ে। বহুদিন ধরে জমে থাকা অভিমান, অবিচার আর অপমান হঠাৎ করেই মুখ ফোটে। সে মায়ের হাত ধরে বলে—
— “মা, আমি বিয়ে করব না। আমি পড়াশোনা করব, মানুষ হব। তুমি আমায় থামিও না।”
মা কাঁদতে কাঁদতে বলে—“তুই তো জানিস, আমরা কিচ্ছু করতে পারি না…”
কিন্তু রমা এবার কারো কথা শোনে না। সে সোজা চলে যায় গ্রামের স্কুলের স্যার অরিন্দম বাবুর কাছে। চোখে চোখ রেখে বলে—
— “স্যার, আমি পড়তে চাই। আমি আপনার সাহায্য চাই।”
স্যার বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকেন কয়েক মুহূর্ত, তারপর বলেন—
— “তুই যদি সাহস রাখিস, আমি তোকে সাহায্য করব। তোর পড়াশোনার দায়িত্ব আমার।”
এই ঘটনার কথা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। কেউ কেউ টিপ্পনী কাটে, কেউ নীরব থাকে, কিন্তু অনেকেই চুপিচুপি রমার পক্ষে দাঁড়ায়।
লক্ষ্মীর মুখ থেকে মুখোশ খসে পড়ে একসময়। ভাই নিজেই প্রতিবাদ করে বলে—“তোর সংসারে রমা শুধু বোঝা নয়, ও ভবিষ্যতের আলো।”
রমা তখন স্কুল পাশ করে কলেজে ওঠে। সেখানেও তার লড়াই থেমে থাকে না। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও সে নিজের যোগ্যতায় একদিন জেলার সেরা হয়।
কয়েক বছর পর—যখন সে বড় শহরের এক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে, গ্রামের মেয়েদের জন্য ফ্রি কোচিং চালু করে দেয়। মা তখন পাশেই থাকে, এক নতুন জীবনে।
রমা একদিন সেই ঘরে ফিরে যায়, যেখান থেকে তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। কাকার চোখে জল, ঠাকুমা এখন আর কথা বলেন না। কিন্তু রমার চোখে নেই কোনো প্রতিশোধের আগুন। সে শুধু বলে—
— “যারা নিজের মেয়েদের বোঝা ভাবে, তাদের বোঝা উচিত—মেয়েরা চাইলে অন্ধকারের মধ্যেও আলো জ্বালাতে পারে।”
শেষ কথা
রমা এখন শুধু এক মেয়ের নাম নয়। সে এক লড়াইয়ের প্রতীক, যে প্রমাণ করে দিয়েছে—
অসহায়তা জন্মগত হতে পারে, কিন্তু সেখান থেকে উঠে দাঁড়ানো সম্পূর্ণ নিজের হাতে।🥰✊