রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ফিরলেন নিজের দেশে -না কোনো প্রটোকল, না কোনো প্রহরী, না কোনো রাজনৈতিক তর্জন-গর্জন। শুধু এক নিঃশব্দ প্রত্যাবর্তন, যেন রাষ্ট্রের বুকেই এক অনুচ্চারিত প্রতিবাদ লিখতে চাইলেন তিনি।
বাংলাদেশের দু’বারের রাষ্ট্রপতি। ছিলেন জাতীয় সংসদের স্পিকার। অথচ চিকিৎসার প্রয়োজনে বিদেশ যাওয়া এবং সেখান থেকে ফেরাকে ঘিরে যেভাবে অপপ্রচার, মিথ্যাচার ও নাটক মঞ্চস্থ হলো, তা কেবল দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতিরই নয়, রাষ্ট্রযন্ত্রের এক অন্তর্নিহিত ভঙ্গুরতারও নগ্ন উদাহরণ।
আওয়ামী লীগের অন্যতম জ্যেষ্ঠ সদস্য আবদুল হামিদের বিদেশে পাড়ি জমানোর পরই পরিস্থিতি পাল্টে দেয়া হয়। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) দাবি তোলে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার। এই দাবির পক্ষে চাপ সৃষ্টির জন্য এনসিপি প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন ‘যমুনা’র সামনেও অবস্থান নেয়। শাহবাগ মাথায় তোলে। ক্রমবর্ধমান এই আর্টিফিসিয়াল চাপের মুখে, অবশেষে ১০ মে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। নির্বাচন কমিশন দলটির নিবন্ধন স্থগিত করে, এবং একাধিক মানবাধিকার সংগঠনের উদ্বেগ উপেক্ষা করে মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন সংশোধন করে আওয়ামী লীগের বিচারধারা অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
এই সময়েই কিছু অদ্ভুত রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত আমরা প্রত্যক্ষ করি—
আব্দুল হামিদের বিদেশযাত্রার জন্য দায় চাপিয়ে পুলিশসহ ইমিগ্রেশন বিভাগের কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। অথচ যখন তিনি দেশে ফিরে এলেন, তখন পুলিশ বলছে -তাঁকে গ্রেপ্তারের কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই।
ডয়চে ভেলেকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি) বাহারুল আলম বলেন:
“তিনি যখন দেশের বাইরে গেছেন, তখনো তাকে গ্রেপ্তার করার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ ছিল না। তাই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। আর এখন ফিরে আসার সময়ও তাকে গ্রেপ্তারের যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ নেই, তাই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। দেশের ভেতরে তাকে গ্রেপ্তারের কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। কোনো কারণ না থাকলে তাকে কীভাবে গ্রেপ্তার করবো?”
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী একই সুরে বলেন:
“উনি যদি দোষী না হন, তাহলে আমরা কেন গ্রেপ্তার করবো? অনেক মামলা হয়েছে। তদন্তে দোষী প্রমাণিত হলে আইনের আওতায় আনা হবে। আপনারাই তো বলেন, অনেক মামলা হয়েছে, যার কোনো ভিত্তি নেই।”
প্রশ্ন ওঠে -তাহলে সাবেক রাষ্ট্রপতি বিদেশ যাওয়ার পর যে ইমিগ্রেশন ও পুলিশের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল, তার ভিত্তি কী ছিল?
এই প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন:
“তিন উপদেষ্টার সমন্বয়ে একটি তদন্ত কমিটি হয়েছে। তাদের রিপোর্টে তারা যদি দোষী না হন, তাহলে তারা রেহাই পাবেন।”
এই বক্তব্যগুলো থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার -রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তগুলো এখনো বস্তুনিষ্ঠ এবং তথ্য ও উপাত্ত ভিত্তিক নয়, বরং পরিস্থিতি-নির্ভর, অস্থির এবং প্রায়ই স্ববিরোধী দ্বিচারিতায় ভরা।
যখন আবদুল হামিদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চলছিল, তখন বলা হচ্ছিল—
• তিনি ‘পালিয়ে গেছেন’
• তিনি আওয়ামী লীগ পুনর্গঠনের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত
• মেয়র আইভী তাঁর সহযোগী, তড়িঘড়ি করে একটা বেইজলেস মামলায় বিরাট আয়োজন করে তাঁকে গ্রেফতার করা হলো
• শাহবাগে জামায়াতি ‘বিপ্লব’ মঞ্চস্থ হলো
• এবং শেষে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করে জুলাই বিপ্লবে পরাজিত বড় রাজনৈতিক দলকে আইনের আসামিতে রূপান্তর করা হলো
কিন্তু আজ? আজ সেই হামিদ দেশে ফিরলেন।
শান্ত, অবিচল, নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে। বললেন, “প্রয়োজনে আমি গ্রেপ্তার হতেও প্রস্তুত। কিন্তু আমি মরবো এই দেশের মাটিতেই।” অথচ রাষ্ট্র এখন বলছে, তাঁকে গ্রেপ্তারের কোনো প্রয়োজন নেই।
তাহলে প্রশ্নগুলো কেন উঠবে না?
১. তিনি যদি গ্রেপ্তারযোগ্য না হন, তাহলে তাঁকে কেন্দ্র করে নাটক কেন?
২. তাঁর বাড়িতে হামলা হয়েছিল কোন ভিত্তিতে?
৩. আইভীর অপরাধ ঠিক কী ছিল?
৪. দল নিষিদ্ধ ঘোষণার সিদ্ধান্তে কী ছিল বিচারিক যুক্তি?
৫. যেসব সরকারি কর্মকর্তা শাস্তি পেলেন, তাঁরা কি শুধুই বলির পাঁঠা? জনগণের চোখে ধূলো দেয়ার বাহানা?
রাষ্ট্র চাইলেও এই প্রশ্নগুলো এড়িয়ে যেতে পারবে না। কারণ, ইতিহাসের চোখ কেবল সাক্ষীই নয়, প্রয়োজনে বিচারকও হয়ে ওঠে।
একটি রাষ্ট্র যদি মিথ্যার উপর ভর করে চলে, তবে সে রাষ্ট্র একসময় নিজের মেরুদণ্ড ভঙ্গুর করে ফেলে। আজকের বাংলাদেশে সত্যকে আড়াল করে যেভাবে ‘মবতন্ত্র’কে রাষ্ট্রশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হচ্ছে, তা কেবল গণতন্ত্রের অপমৃত্যুই নয়, বরং একটি জাতির আত্মিক পরাজয়ের নামান্তরও হতে পারে।
আওয়ামী লীগের কৃতকর্মের দায়ে আব্দুল হামিদ যদি দোষী হন, তাঁকে আইনের আওতায় আনা হোক। আর যদি না হন, তবে এই রাষ্ট্র কীভাবে তাঁর সঙ্গে এমনতর আচরণ করলো, সেজন্য জাতির কাছে জবাবদিহি করতে হবে। এটাই সভ্যতার দাবি। নৈতিকতার দাবি। রাষ্ট্রবোধের দাবি। আগলে রাখা মিথ্যার অপনোদন জরুরি সত্য প্রতিষ্ঠার স্বার্থে। আমরা সর্বাবস্থায় সত্য ও সুন্দরের পূজারি।
লেখক: সাংবাদিক
৯ জুন ২০২৫