সমুদ্র তীরের সেই পুরনো বাড়িটা
গভীর রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে শুধু সমুদ্রের গর্জন শোনা যাচ্ছিল। পুরনো কাঠের বাড়িটার ভাঙা জানালা দিয়ে একটানা বাতাস ঢুকে ভেতরের ধুলো ওড়াচ্ছিল। অরুণ, তার টর্চের আলো ফেলে সাবধানে এগোচ্ছিল। এই বাড়িটা নিয়ে নানা গল্প শোনা যায়। গ্রামের লোকজন বলে, এই বাড়িতে নাকি এক অশরীরী আত্মা থাকে, যে পূর্ণিমার রাতে সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে মিশে যায়।
অরুণ এসব গল্পে বিশ্বাস করে না। সে পেশায় একজন প্রত্নতত্ত্ববিদ, আর তার কাছে এসবই গাঁজাখুরি। সে এসেছে একটা পুরনো মানচিত্রের সূত্র ধরে, যেখানে এই বাড়ির নিচে নাকি গুপ্তধন লুকানো আছে। মানচিত্রটা সে পেয়েছিল তার দাদার পুরনো জিনিসপত্র ঘাঁটতে গিয়ে। দাদা জীবদ্দশায় এই বাড়িটার কথা প্রায়ই বলতেন, রহস্যময় হাসি হেসে বলতেন, "কিছু জিনিস যেমনটা দেখায়, তেমনটা নয়।"
টর্চের আলোয় ঘরের দেয়ালগুলোতে পুরনো ছবি আর জীর্ণ আসবাবপত্রের ছায়া নাচছিল। প্রতিটি পদক্ষেপে মেঝে থেকে একটা খসখস শব্দ আসছিল, যেন অনেক দিনের পুরনো শুকনো পাতা ভেঙে যাচ্ছে। অরুণ একটা বড় হলঘরের মাঝখানে এসে দাঁড়াল। মানচিত্র অনুযায়ী, গুপ্তধনের সুনির্দিষ্ট স্থানটা এখানেই। একটা ভাঙা ড্রেসিং টেবিল, তার ওপর একটা মরিচা ধরা মোমদানি আর একটা আয়না। আয়নাটা এতই ঘোলাটে যে মুখ দেখা যাচ্ছে না।
অরুণ মানচিত্রটা বের করে দেখল। হলঘরের মাঝখান থেকে ড্রেসিং টেবিলের ঠিক নিচে একটা X চিহ্ন দেওয়া আছে। সে টেবিলটা সরানোর চেষ্টা করল। অনেক কষ্টে টেবিলটা সরাতেই মেঝের কাঠগুলো আরও পুরনো আর ফাটল ধরা মনে হলো। নিচু হয়ে মেঝে পরীক্ষা করতেই অরুণ দেখল, একটা কাঠের তক্তা অন্যগুলোর চেয়ে একটু আলগা। তার বুক ধড়ফড় করে উঠল।
সাবধানে আলগা তক্তাটা সরাতেই একটা কালো গর্ত বেরিয়ে এলো। অরুণ টর্চের আলো ফেলতেই দেখল, গর্তের ভেতরে একটা ছোট লোহার সিন্দুক। সিন্দুকটা আকারে ছোট হলেও বেশ ভারী। সে অনেক কষ্টে সেটাকে টেনে বের করল। সিন্দুকের গায়ে পুরনো কারুকার্য, আর একটা তালা লাগানো। তালাটা খুলতে সমস্যা হচ্ছিল না, কারণ ওটা অনেক আগেই মরিচা ধরে গেছে।
অরুণ তালাটা ভেঙে সিন্দুকের ঢাকনা খুলল। ভেতরে ছিল না কোনো সোনাদানা, বা মূল্যবান রত্ন। যা ছিল, তা দেখে অরুণের মুখে এক অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠল। সিন্দুকের ভেতরে একটা জীর্ণ খাতা, কিছু পুরনো চিঠি আর একটা ছোট সোনার মেডেল। মেডেলটার গায়ে লেখা, "প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, ১৯১৭"। আর খাতার প্রথম পাতায় লেখা, "আমার প্রিয় ডায়রি"।
অরুণ ডায়রিটা হাতে নিল। ধুলো ঝেড়ে পাতা উল্টাতেই সে এক ভিন্ন জগতে প্রবেশ করল। ডায়রিটা লেখা ছিল একজন ব্রিটিশ সৈনিকের হাতে, যার নাম ছিল 'ক্যাপ্টেন জন স্মিথ'। জন স্মিথ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন এবং গুরুতর আহত হয়ে এই নির্জন বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তিনি তার ডায়রিতে যুদ্ধের ভয়াবহতা, তার প্রিয়জনের প্রতি ভালোবাসা এবং জীবনের অনিশ্চয়তা নিয়ে লিখেছেন। প্রতিটি শব্দে তার গভীর অনুভূতির ছাপ ছিল।
অরুণ চিঠিগুলোও পড়ল। সেগুলো ছিল ক্যাপ্টেন স্মিথের স্ত্রীর লেখা। প্রতিটি চিঠিতে ভালোবাসা আর উদ্বেগের ছাপ স্পষ্ট। তারা একে অপরের থেকে দূরে থেকেও যে গভীর বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন, তা অরুণের চোখে জল এনে দিল। মেডেলটা ছিল জন স্মিথের সাহসিকতার প্রতীক।
অরুণ গুপ্তধনের খোঁজে এসেছিল, কিন্তু সে পেল এক মানুষের জীবনের গভীর গল্প। সেই সৈনিকের আত্মত্যাগ, ভালোবাসা আর হারানোর বেদনা যেন তার চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠল। অরুণ বুঝল, আসল গুপ্তধন সোনা-রূপায় নয়, বরং মানুষের গল্পে, স্মৃতিতে আর আবেগে লুকিয়ে থাকে। এই ডায়রি, চিঠি আর মেডেল ছিল ক্যাপ্টেন স্মিথের জীবনের প্রতিচ্ছবি, যা কালের গর্ভে চাপা পড়েছিল।
অরুণ সিন্দুকের ঢাকনা বন্ধ করে দিল। সমুদ্রের গর্জন তখন আরও জোরালো হয়েছে। সে জানত, এই গুপ্তধনের মূল্য কোনো সোনার চেয়ে কম নয়। এই পুরনো বাড়িটা এখন আর শুধু একটা ভূতুড়ে বাড়ি নয়, এটা এক সৈনিকের নীরব সাক্ষী, যে তার ভালোবাসার চিহ্ন রেখে গেছে ইতিহাসের পাতায়। অরুণ সিন্দুকটা সাবধানে আবার গর্তে রেখে দিল। এই গল্পটা তার সাথে থাকবে, এক অমূল্য সম্পদ হয়ে।
আপনার কি অন্য কোনো বিষয় বা ধরনের গল্প শুনতে ভালো লাগবে?
131
View