অরবিন্দ স্বভাবতই শান্ত ও অন্তর্মুখী। তবুও যার সঙ্গেই সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, তার প্রতি ছিল নিঃস্বার্থ আন্তরিকতা। যাদের একদিন বন্ধু বলে জেনেছিল, তাদের জন্য সে সময় দিতে কোনো দিনই কুণ্ঠিত হয়নি-নিজের ব্যস্ততাকে যেন এক মুহূর্তে পিছনে সরিয়ে দিতে পারত।
কিন্তু সময় এক অদ্ভুত জিনিস- সে শুধু ক্যালেন্ডারের পাতা পাল্টায় না, পাল্টে দেয় মানুষকে, সম্পর্ককে, এমনকি হৃদয়ের অনুভূতিকেও।
রবিন ছিল অরবিন্দের কলেজজীবনের প্রিয় বন্ধু।
সেই বন্ধুত্ব ছিল একান্ত, হৃদয়ের মতো আন্তরিক।
বৃষ্টির দিনে ছাতা ভাগ করে ভিজে যাওয়া,
রাতের ক্ষুধায় এক রুটি দু’ভাগে ভাগ করা
আর পরীক্ষার আগের রাতে বই এগিয়ে দিয়ে বলা-
এইটা তোর লাগবে, রেখে দে… আমি পরে দেখে নেব।
সময় গড়িয়ে গেছে, জীবন বদলেছে ধারা।
রবিন আজ জীবনের নতুন অধ্যায়ে পা রাখতে চলেছে- বিয়ে।
সযত্নে পাঠিয়েছে নিমন্ত্রণপত্র, তারপর একদিন ফোন করে বলল,
অরবিন্দ, তুই না এলে খুব কষ্ট পাবো রে!
অরবিন্দ ফোনের অন্যপ্রান্তে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নরম স্বরে বলল,
রবিন ভাই, বিশ্বাস কর, ইচ্ছা থাকলেও হয়তো আসতে পারব না।
ব্যক্তিগত কিছু জটিলতা চলছে…
কিছু দায়িত্ব আছে যেগুলো এড়িয়ে যাওয়া আমার পক্ষে কঠিন।
তুই তো জানিস, আমি কখনো কোনো সম্পর্ককে অবহেলা করি না।
ওপাশের কণ্ঠস্বর হঠাৎই রূঢ় হয়ে ওঠে,
সেই স্বরে ছিল অপমান, অবিশ্বাস আর অবজ্ঞার বিষ।
আরে ওসব বাজে কথা রাখ!
সবাই তো এখন এরকম অজুহাত বানায়,
আসতে চাই না বলেই গল্প বানাস!
ঠিক আছে, বুঝে নিলাম- তুই আমার বন্ধু ছিলি কিন্তু এখন আর না।
তোকেও আর বন্ধু ভাবার দরকার নেই।
শব্দগুলো অরবিন্দকে চমকে দেয়নি কিন্তু ভেতরে একটা ধাক্কা দিয়েছিল।
বন্ধুত্ব যখন অবিশ্বাসে ডুবে যায়,
তখন কোনো তর্ক বা ব্যাখ্যাই সেই ব্যথা উপশম করতে পারে না।
সে কিছু বলে না। চুপচাপ ফোনটা রেখে দেয়।
আর হৃদয়ের এক কোণায় জমে থাকা নিরবতা গুমরে কেঁদে ওঠে।
ঘরজুড়ে এক নিস্তব্ধতা নেমে আসে- নীরব অথচ ভারী।
শব্দহীনতার মধ্যেই যেন কোথাও চাপা চিৎকার ঘুরপাক খায়, যা ভাষার চেয়ে গভীর আর কণ্ঠস্বরের চেয়েও তীক্ষ্ণ।
অরবিন্দ নিঃশব্দে উঠে গিয়ে এক কাপ চা বানায়। বারান্দায় এসে বসে।
দূরের আকাশে মেঘের হালকা ভাঁজ জমে উঠেছে, সূর্যের আলো ম্লান হয়ে গেছে, চারপাশে এক রকম ধূসর নরমতা।
একটানা ডাকে কোনো নাম না-জানা পাখি- ঐ দূরের গাছের ডাল থেকে।
অরবিন্দ তাকিয়ে থাকে- শুধু চা নয়, মনে যেন বিষাদের ধোঁয়াও উঠছে ধীরে ধীরে।
তার মন বলে ওঠে,
মানুষের মুখ যত না বলে, তার চেয়ে অনেক বেশি বলে একেকটা নিরবতা।
কিছুক্ষণ পর নিজের ডায়েরি খুলে লিখে ফেলে একটি লাইন-
যে মানুষ কথার মূল্য বোঝে না, সে মানবতার আলো হারায় আর বন্ধুত্বের শিকড় উপড়ে ফেলে নিজের অজান্তেই।
সেই রাতে অরবিন্দ আর কোনো অভিমান রাখে না, শুধু হৃদয়ের এক কোণায় একটা ক্ষীণ শূন্যতা জমিয়ে রাখে। হয়তো সময়ের সাথে সেটাও ধুয়ে-মুছে যাবে।
রবিনের বিয়ে হয়। সামাজিক মাধ্যমে ভেসে ওঠে ঝলমলে ছবি-হাসিমাখা মুখ, হাতে মেহেন্দির নকশা, গলায় ফুলের মালা। চারপাশে আনন্দের ছটায় যেন সব পরিপূর্ণ। তবুও কোথাও একটা শূন্যতা জমে থাকে- একজন ছিল না সেই বিয়েতে, যে নিরবে বুঝতে পারত বন্ধুত্বের অভিমানটা কতটুকু নরম ছিল আর অপমানের ঘা ঠিক কতটা নিঃশব্দে গহীনে বাজে।
আমরা যখন কারো আন্তরিক কথাকে ‘অজুহাত’ বলে উড়িয়ে দিই, তখন সম্পর্ক শুধু ভাঙে না- মানবতা থেকে আমাদের একটা অংশ চিরতরে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। যে মানুষ কথার মর্যাদা বোঝে না, সে সত্যিকারের মানবতা বিবর্জিত ও সামাজিকভাবে বেমানান।
তাং- ১০/০৬/২০২৫ ইং