বাংলাদেশের গ্রামীণ বা শহুরে জনজীবনে বিগত কয়েক বছরে ক্রমবর্ধমান হিংসা, অসহিষ্ণুতা ও অদ্ভুত রকমের ‘র্যাডিক্যাল মেন্টালিটি’ আমাদেরকে কঠিন প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাচ্ছে প্রতিনিয়ত। কারো কথা কারো গায়ে সয় না! সবাই যেন সব ব্যাপারেই সমান প্রতিক্রিয়াশীল। খুব বেশি ভাবতে হচ্ছে আমরা আসলে কারা? আমরা এমন হয়ে গেলাম কেন?
জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কিংবা বাজারচলতি মূলধারার গণমাধ্যমেও এখন প্রায় প্রতিদিনই উঠে আসছে এমন সব খবর -যেখানে শসা চুরি বা টিস্যু না দেওয়া, সিনেমা প্রদর্শনী বন্ধ কিংবা ব্যক্তি মতাদর্শের কারণে সংঘর্ষ, গণপিটুনি এমনকি আত্মহত্যার মতো ঘটনা ঘটছে। এই প্রবণতা নিছক বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং বৃহত্তর মানসিক ও রাজনৈতিক সংকটের প্রতিফলন।
সামাজিক বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরেই মূল্যবোধের অবক্ষয় চিহ্নিত করে আসছেন। Durkheim-এর "anomie" তত্ত্ব অনুযায়ী, যখন সমাজে প্রতিষ্ঠিত সামাজিক মান ও নিয়মগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন ব্যক্তিরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে, যা সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও সহিংসতা বাড়ায়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে, এই ‘anomic state’-এর প্রকাশ ঘটছে শিক্ষিত তরুণের আত্মহনন, গ্রামবাসীর নিছক অপবাদ দিয়ে মানুষকে হেনস্তা করার মধ্য দিয়ে।
মানিকগঞ্জের অধিবাসী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রকে "নাস্তিক" বলে অপবাদ দেওয়া হয়, যা তার আত্মহত্যায় পরিণতি পায়। সে তার সুইসাইড নোটে আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাসের কথা লিখে গেলেও নিজের ও পরিবারের অপমানের ভার বহন করতে পারেনি।
অপরদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দুটি গ্রামে সামান্য শসা চুরি বা হোটেলে টিস্যু না দেওয়ার মতো ঘটনা থেকেই শতাধিক আহতের অহেতুক সংঘর্ষ -অমন একটা মনস্তাত্ত্বিক উন্মত্ততাই নির্দেশ করে।
আত্মস্বার্থনিমগ্ন অপরাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ও বিচারহীনতা গ্রাম্য পেশিশক্তিকে বৈধতা দিয়েছে। একে বলে "mob legitimization"। বিচারহীনতার এই সংস্কৃতি Gramsci-র "hegemony of power" ধারণার সঙ্গে মিলে যায় -যেখানে ক্ষমতাসীন শ্রেণি গোষ্ঠীগত উগ্রতাকে ব্যবহার করে নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখে।
টাঙ্গাইলে ‘তাণ্ডব’ সিনেমা বন্ধ করা, সিলেটের উৎমাছড়ায় সংঘবদ্ধ মব কর্তৃক পর্যটক তাড়িয়ে দেওয়া, শাহজাদপুরে রবীন্দ্র কাছারিবাড়িতে হামলা -সব কিছুর পেছনে এক ধরনের ‘মোড়লতন্ত্র’ কাজ করছে, যারা বিকৃত রাজনীতির ছত্রছায়ায় "পবিত্রতা রক্ষার" নামে সামাজিক সন্ত্রাস চালায়।
"Moral panic" ও digital vigilantism আমাদের সমাজে ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে। স্ট্যানলি কোহেনের “moral panic” ধারণা অনুসারে, যখন সমাজে একটি ছোট্ট ইস্যুকে অতিকায় করে তোলা হয়, তখন জনতা নিজেদেরকেই বিচারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ করে। সামাজিক মাধ্যমে একটি ভিডিও, একটি পোস্ট বা অভিযোগ মুহূর্তে ভাইরাল হয়ে যায়, মানুষ বিচার না করে হিংস্র হয়ে ওঠে। গ্লানিকর জিঘাংসা দেখায়।
বাংলাদেশের এখনকার "শিক্ষা" মানে বেশি নম্বর, গোল্ডেন জিপিএ, ভালো চাকরি, মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং বা বিসিএস। মানবিক বিদ্যা, নৈতিক শিক্ষা, সহনশীলতা, যুক্তিবাদিতা -এসব নেই বললেই চলে। Paulo Freire-এর “banking concept of education”-এর মতোই, এখানে ছাত্ররা কেবল তথ্য জমা রাখে, মানবতা শেখে না। ফলে, বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীও হয়ে ওঠে অসহিষ্ণু, একই সঙ্গে গ্রামের অশিক্ষিত অংশ হয়ে ওঠে উগ্র ধর্মীয় বা গোষ্ঠীগত রক্ষণশীলতার ধারক।
বাংলাদেশ দীর্ঘদিন দিন ধরেই উত্তেজনাময় রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও উদ্বেগজনিত মানসিক ব্যাধির ভয়াল খপ্পরে পড়েছে। দেশে এক দশকের বেশি সময় ধরে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির চূড়ান্ত দমন, মত প্রকাশের স্বাধীনতায় লাগাম ও প্রশাসনিক নির্লিপ্ততা মানুষকে aggressive dissonance-এ ঠেলে দিয়েছে। গেল ১১ মাসে অন্তর্বর্তী সরকারের জামানায় এই অবস্থা এতটুকু বদলায়নি, স্বরূপ পরিবর্তন করেছে মাত্র।
American Psychological Association অনুযায়ী, দীর্ঘ সময় ধরে দমন-পীড়নের শিকার জনগণ মানসিকভাবে হয়ে পড়ে বিভ্রান্ত, ভীত ও উত্তেজনাপ্রবণ। একে বলে chronic societal stress। এই চাপের বহিঃপ্রকাশ ঘটে ক্ষুদ্র ঘটনায় অতি-প্রতিক্রিয়া হিসেবে।
এমন ভীতিকর পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সমাধান বা করণীয় কী:
১. নৈতিক শিক্ষা পুনঃস্থাপন করতে হবে শিক্ষাব্যবস্থায়। কেবলমাত্র ধর্মীয় শিক্ষা নয়; যুক্তিভিত্তিক, বিজ্ঞানমনস্ক ও মানবিকতা ভিত্তিক শিক্ষা সবার আগে প্রয়োজন।
২. সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে সামাজিক মাধ্যমে গুজব শনাক্তকারী ফ্যাক্ট-চেক ইউনিট আরও সক্রিয় করা জরুরি।
৩. স্থানীয় রাজনীতির মোড়লতন্ত্র ও ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠীর ওপর নজরদারি বাড়াতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে স্থানীয় সন্ত্রাস দমনেও সক্রিয় হতে হবে, শুধু রাজনৈতিক বিরোধী মত দমনে নয়।
৪. গণমাধ্যমে ইতিবাচক সমাজচিত্র প্রচার বাড়াতে হবে। প্রতিরোধকারী চরিত্রদের কভারেজ ও মূল্যায়ন সবার আগে জরুরি।
৫. মেন্টাল হেলথ সাপোর্ট সিস্টেম ইউনিয়ন পর্যায়ে জরুরি। গ্রামীণ মানসিক কাউন্সেলিং প্রোগ্রাম হাতে নিতে পারে সরকার।
৬. মানুষের সমানাধিকার ওই মানুষের কাছেই ফেরাতে হবে। বাক স্বাধীনতাসহ মৌলিক অধিকার কঠোরভাবে নিশ্চিত করতে হবে।
৭. সর্বোপরি পরমতসহিষ্ণু রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা জরুরি। কোনো অবস্থাতেই বিরাজনীতিকরণকে সমর্থন না দিয়ে বিশুদ্ধ গণতন্ত্রের পথরেখা খুঁজতে হবে।
বাংলাদেশের এই সামাজিক হিংসা, অপবাদ-সন্ত্রাস, হিপোক্রিসি, উগ্রবাদ, মানসিক অসহিষ্ণুতা ও মবোক্রিসি -এসব কেবল কিছু ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ মাত্র নয়, বরং আমাদের মানসিক, রাজনৈতিক ও নৈতিক সংকটের অভিন্ন বহিঃপ্রকাশ। আমরা যদি এখনই আমাদের শিক্ষা, রাজনীতি ও সামাজিক সম্পর্কের কাঠামো পুনর্গঠনে মনোযোগ না দিই, তাহলে সমাজে ন্যায়, ভালোবাসা, মায়া, সহমর্মিতা ও মানবিকতা আরও কোণঠাসা হয়ে পড়বে। পথ হারিয়ে দুর্মর গোলক ধাঁধায় আটকে যাবো আমরা।
রেফারেন্স:
• Durkheim, Émile. Suicide: A Study in Sociology. 1897
• Cohen, Stanley. Folk Devils and Moral Panics. 1972
• Freire, Paulo. Pedagogy of the Oppressed. 1970
• American Psychological Association. “Chronic Societal Stress and Collective Trauma.” (2022)
• Zuboff, Shoshana. The Age of Surveillance Capitalism. 2019 (গুজব, ভয়ের রাজনীতি ও সামাজিক অস্থিরতার ব্যাখ্যা)
লেখক: সাংবাদিক
১১ জুন ২০২৫