Posts

চিন্তা

ইউনূস-তারেক ক্লোজ ডোর বৈঠক: কার কী লাভ?

June 11, 2025

ফারদিন ফেরদৌস

219
View

এই মুহূর্তে দেশের রাজনীতির সবচেয়ে চর্চিত ও রহস্যঘন ইভেন্ট কোনটি? নিঃসন্দেহে ১৩ জুন লন্ডনের ডরচেস্টার হোটেলে অনুষ্ঠিতব্য এক বৈঠক -যেখানে মুখোমুখি হবেন দেশের অন্যতম আলোচিত রাজনীতিক, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। বৈঠকটি বন্ধ দরজার আড়ালে, তবে এর প্রতিধ্বনি কেবল ওই হোটেল কক্ষেই আটকে থাকবে না -ঢাকা থেকে ওয়াশিংটন, দিল্লি থেকে ব্রাসেলস পর্যন্ত বিস্তৃত রাজনৈতিক রাডারে তা প্রতিফলিত হবে।

এই আলোচনার উদ্দেশ্য আসলে কী?
তারেক রহমান ইতোমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছেন, ডিসেম্বরেই নির্বাচন চাই, গণ-আন্দোলন পরবর্তী সংস্কারে নেই তেমন কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি। অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান আগামী বছরের এপ্রিলের প্রথমার্ধের যেকোনো দিন নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করেছেন। সেখানেই মতবিরোধের সূচনা। কিন্তু বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার বার্তা দলের প্রতি স্পষ্ট -প্রফেসর ইউনূসের সঙ্গে কোনো প্রকার বিরোধে যেন জড়ানো না হয়। তাহলে এই ওয়ান-টু-ওয়ান বৈঠকের মর্মকথা কী হতে চলেছে?

বিএনপির হাইকমান্ডের বক্তব্য, এই বৈঠক রাজনীতির মাঠে এক সুবাতাস আনবে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তো এটিকে রাজনৈতিক সংকট নিরসনের টার্নিং পয়েন্ট বলেই অভিহিত করেছেন।

আমরা ধরে নিতে পারি, প্রফেসর ইউনূস এই বৈঠকের মাধ্যমে নিজের মদতপুষ্ট দল এনসিপির জন্য রাজনৈতিক জমি চেয়েই আলোচনায় বসছেন। বাস্তবতা হলো -নতুন গজানো পাতার মতো ওই দলে এখনো শিকড় গজায়নি, বরং নানা বিতর্কে পাতাও শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম। তৃণমূলে নেই তেমন কোনো পরিচিতি। আমাদের গ্রামের তিনরাস্তার মোড়ের বটতলায় ত্রিশ বছর ধরে চা বানানো সেই দাঁত খসে পড়া পাকাচুল দাদু এখনো এনসিপির নাম জানেন না, কিন্তু বিএনপির আদ্যন্ত তাঁর মুখস্থ। তিনি এবং তার পরিবারের ভোটই তো মূলত গণতন্ত্রের অক্সিজেন!

প্রফেসর ইউনূস জানেন, আওয়ামী লীগের অবর্তমানে বিএনপির প্রতিদ্বন্দ্বী এখনো এই দেশে তৈরি‌ হয়নি। আবার কৌশলগত কারণে আওয়ামী লীগের ভোট বিএনপি বা জামায়াতে ভাগাভাগি হতে পারে; কিন্তু এনসিপিতে যৎসামান্যই যেতে পারে। তার ওপর ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় মুরুব্বিদের প্রেসক্রিপশন মেনে জুলাই আন্দোলনে পরাজিত আওয়ামী লীগ যদি ভোটে ফিরে আসে তখন আবার শুরু হবে আরেক ধরনের খেলা। তারপরও বিএনপির অবস্থান খুব বেশি হেরফের হবে না। গেল ১৫ বছর যেহেতু আওয়ামী লীগ সবচেয়ে বেশি কোণঠাসা বিএনপিকেই করে রেখেছিল, সেহেতু বিবর্তনবাদ থিওরির প্রাকৃতিক নির্বাচনের নিয়মে এবারের টার্ন ঘুরেফিরে ওই বিএনপির।

এমন বাস্তবতায় প্রফেসর ইউনূসের কৌশলগত উপলব্ধি অত্যন্ত গভীর -আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে বিএনপিই একমাত্র শক্ত প্রতিপক্ষ। এনসিপি বা জামায়াতকে বিরোধী দলের লেবেল নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। যদিও তারা যতই আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে "দুই সাপের এক বিষ; নৌকা আর ধানের শীষ" বলুক না কেন!

প্রফেসর ইউনূস কখনো রাজনীতি করেননি, তবে রাজনীতি তাঁর রন্ধ্রে। বিগত এগারো মাসে শেখ হাসিনার গড়া এস্টাবলিশমেন্টের ছায়াতলে দাঁড়িয়ে রাজনীতির অন্দরমহল তাঁর ভালোই চেনা হয়ে গেছে। ফলে তিনি জানেন কবে কোথা থেকে কিভাবে সেইফ এক্সিট নিতে হয়। পরবর্তীতে আবার রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে প্রোটাগনিস্ট চরিত্র হিসেবে নিজের প্রাসঙ্গিকতা ও গ্রহণযোগ্যতা বজায় রাখতে হয়। তারেক রহমানের সঙ্গে কৌশলগত আলাপ ওইজন্যই জরুরি।

তাতে তারেকের ক্ষতি কী? বরং লাভ তো দুই দিকেই। একটি সম্মানজনক সমঝোতার মঞ্চ, যেখানে চূড়ান্ত দরকষাকষিতে দু’পক্ষই কিছু না কিছু পাবে। বিএনপি ডিসেম্বরে নির্বাচন চাইছে।তাহলে প্রশ্ন -প্রফেসর ইউনূস কী চাইতে পারেন?
১. এনসিপির জন্য কিছু প্রভাবশালী আসন?
২. জামায়াতকে খুশি রাখার মতো একটা কৌশলগত প্যাকেজ?
৩. পরবর্তী সরকারে নিজের জন্য রাষ্ট্রপতির পদমর্যাদা?
৪. সর্বোপরি, আওয়ামী লীগকে যেন আর রাজনৈতিক মঞ্চে ফিরতে না দেওয়া হয় -এই চুক্তিতে সবাইকে এক ছাতার নিচে আনা?

এমনও হতে পারে, নির্বাচন আদৌ ডিসেম্বর বা এপ্রিলে নয় -বরং ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে এক আপোষসুলভ সমাধান হতে পারে অথবা ডিসেম্বর বা এপ্রিলের যেকোনো একটিতে দুই পক্ষের সমঝোতা হতে পারে। রাজনীতিতে 'সময়' তো শেষ কথা নয়, 'সময়কে কে কতটা বশে আনতে পারে' সেটাই আসল।

আমরা ধারণা করি, প্রফেসর ইউনূস যেন দরকষাকষির সুতোটা ধরে রাখতে পারেন, সেই কারণেই এখনো তারেক রহমানের দেশে ফেরা আটকানো হয়েছে। তাকে এখনো সমস্ত মামলা থেকে খালাস দিয়ে দেশে ফিরিয়ে আনার পথে হাঁটা হয়নি। অনেকটা সেই পুরনো কৌশল‌ -যেভাবে জেনারেল মঞ্জুর হত্যা মামলার ফাঁস চেপে চেপে শেখ হাসিনা এরশাদকে ঠেসে ধরেছিলেন। সেই সূত্রেই বলা যায়, তারেক রহমানের দেশে ফেরা মূলত রাজনৈতিক সিন্দুকের চাবিকাঠির মতো -যার খোলা না খোলার অধিকার আপাতত ইউনূস সরকারের হাতে। এখন প্রফেসর ইউনূসের তরফে রাজনৈতিক হিস্যাজাতীয় আবদারে প্রাপ্যতার সম্ভাবনার সমানুপাতিক হবে দেশে ফিরে তারেকের স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবার উদগ্র আকাঙ্ক্ষা।

মোটের ওপর, যদি বৈঠকের ফল ইতিবাচক হয়, তবে উভয় পক্ষই নিজ নিজ পালে হাওয়া লাগাতে পারবে। রাজনীতির এই কুরুক্ষেত্রে সবাই জিততে চায় -হারা দলের জায়গা হয় ইতিহাসের গহ্বরে, কিংবা আন্দামানের নির্বাসনে। কে-ই বা চায় পরাজয়ের বিষ পান করে বেদনার সমুদ্রে ডুবে যেতে?

লেখক: সাংবাদিক
১১ জুন ২০২৫

Comments

    Please login to post comment. Login