শান্ত এক গ্রীষ্মের দুপুর। মেঘলা আকাশ, কিন্তু বৃষ্টি নেই। শহরের কোলাহল থেকে দূরে, একটি পুরনো বাড়ির চিলেকোঠায় বসে ছিল রনি। হাতে তার একটি বই, কিন্তু মনটা ছিল অন্য কোথাও। আজ সকালে দেখা একটি অদ্ভুত স্বপ্ন তাকে অস্থির করে তুলেছিল।
স্বপ্নে রনি নিজেকে দেখেছিল এক অচেনা দ্বীপে। চারদিকে ঘন জঙ্গল, আর তার মাঝখানে একটি প্রাচীন মন্দির। মন্দিরের ভেতরে ছিল একটি বিশাল দরজা, যেটা খুলতেই দেখা গেল এক ঝলমলে আলোর রেখা। সেই আলোর টানে রনি এগিয়ে যেতেই তার ঘুম ভেঙে যায়।
রনি বইটা রেখে জানালার বাইরে তাকাল। স্বপ্নটা এতটাই বাস্তব মনে হচ্ছিল যে, তার মন চাইছিল সেই দ্বীপটা খুঁজে বের করতে। সে জানত এটা প্রায় অসম্ভব, কিন্তু তার অ্যাডভেঞ্চারের নেশা তাকে ছাড়ছিল না।
সেদিন বিকেলে রনি তার প্রিয় বন্ধু মিতুকে সব খুলে বলল। মিতু প্রথমে হেসে উড়িয়ে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু রনির চোখে সে দেখল এক অদ্ভুত জেদ। শেষমেশ মিতু রাজি হলো রনিকে সাহায্য করতে।
তারা দু'জন মিলে পুরনো মানচিত্র ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করল। ইন্টারনেটে খুঁজতে লাগল অচেনা দ্বীপের খবর। কয়েকদিন ধরে তাদের এই অনুসন্ধান চলতে লাগল। একদিন, একটি পুরনো সামুদ্রিক জার্নালে তারা খুঁজে পেল একটি অদ্ভুত দ্বীপের বর্ণনা। বর্ণনার সাথে রনির স্বপ্নের অনেক মিল ছিল। দ্বীপটি ছিল ভারত মহাসাগরের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে, যার নাম ছিল 'হারানো দ্বীপ'।
হারানো দ্বীপের উদ্দেশে রওনা হওয়া সহজ ছিল না। অনেক বাধা পেরিয়ে, নানা প্রতিকূলতার সাথে লড়াই করে তারা একটি ছোট মালবাহী জাহাজে চড়ে বসল। জাহাজের ক্যাপ্টেন প্রথমে তাদের কথা বিশ্বাস করতে চাননি, কিন্তু রনির দৃঢ়তা দেখে তিনি তাদের হারানো দ্বীপের কাছাকাছি নামিয়ে দিতে রাজি হলেন।
কয়েকদিনের দীর্ঘ যাত্রা শেষে তারা পৌঁছাল সেই দ্বীপের কাছে। দ্বীপটি সত্যিই স্বপ্নের মতো ছিল। ঘন সবুজ বন, অদ্ভুত পাখির ডাক আর সমুদ্রের গর্জন। তারা সাবধানে দ্বীপে নামল এবং জঙ্গল ভেদ করে পথ খুঁজতে লাগল।
দীর্ঘ পথ হাঁটার পর, তারা এক জায়গায় এসে থমকে গেল। তাদের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল সেই প্রাচীন মন্দির। রনির শরীর দিয়ে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। এটা সত্যিই তার স্বপ্নের মন্দির!
তারা সাবধানে মন্দিরের ভেতরে প্রবেশ করল। ভেতরে পুরনো পাথরের দেয়াল, লতাপাতায় ঢাকা। আর মাঝখানে সেই বিশাল দরজা! রনি ধীরে ধীরে দরজার কাছে এগিয়ে গেল। তার হাত কাঁপছিল। সে দরজায় হাত দিতেই দরজাটি আপনাআপনি খুলে গেল।
ভেতরে ছিল সেই ঝলমলে আলো। তবে এবার আলোটা আরও উজ্জ্বল ছিল। রনি এবং মিতু আলোর দিকে এগিয়ে গেল। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হলো, আলোর শেষ প্রান্তে কোন গুপ্তধন বা অন্য কিছু ছিল না। সেখানে ছিল একটি বড় আয়না, যা সেই আলোর উৎস। আয়নার দিকে তাকাতেই তারা নিজেদেরকে দেখতে পেল, কিন্তু এক অন্য রূপে। তারা দেখল তাদের ভেতরের সত্যিকারের সত্তাকে, তাদের সাহস, তাদের বন্ধুত্ব আর অ্যাডভেঞ্চারের প্রতি তাদের অদম্য ইচ্ছাকে।
তারা বুঝতে পারল, এই মন্দির বা আলো কোনো গুপ্তধনের জায়গা নয়। এটা ছিল তাদের নিজেদের ভেতরের শক্তিকে খুঁজে বের করার একটি যাত্রা। স্বপ্নটা ছিল তাদের নিজেদেরকে আবিষ্কার করার একটি পথ। তারা হাসল। এত পরিশ্রমের পর তারা যা খুঁজে পেল, তা কোনো সোনা-রুপার চেয়েও মূল্যবান ছিল। তারা একে অপরের দিকে তাকাল। তাদের চোখ ভরে ছিল এক নতুন উপলব্ধিতে।
সেই দিন থেকে রনি এবং মিতু জানত যে আসল অ্যাডভেঞ্চার বাইরের জগতে নয়, বরং নিজের ভেতরের আবিষ্কারে।
52
View