প্রফেসর ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার যেহেতু জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত নয়, স্বাভাবিকভাবেই তাদের উপর পাঁচ বছরের ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত সরকারের মতো জবাবদিহির চাপ বর্তায় না। তবুও, এই স্বল্প সময়ের শাসনকালেই যা ঘটছে, তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় গুরুত্বহীন নয় মোটেই।
অবশ্যই, ইউনূস সরকারের কিছু উদ্যোগ ইতিবাচক; আমরা তার যথাযথ স্বীকৃতিও দিতে কার্পণ্য করি না। উদাহরণস্বরূপ, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন প্রস্তুতের উদ্যোগটি ছিল প্রশংসনীয়। তবে, দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সেই প্রতিবেদন বাস্তবায়নে সরকারের আন্তরিকতার ছাপ দেখা যাচ্ছে না। আমরা আশা করেছিলাম, সরকার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারকে অগ্রাধিকার দিয়ে দ্রুত প্রয়োগে মনোনিবেশ করবে। কিন্তু সেই আশাও ক্রমশ ধুলোয় মিশে যাচ্ছে।
এই মুহূর্তে, ইউনূস সরকার সবচেয়ে বড় যে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, তা হলো কূটনৈতিকভাবে চূড়ান্ত ভরাডুবি। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বারবার দাবি করে এসেছেন যে, যুক্তরাজ্য সরকারের আমন্ত্রণে অধ্যাপক ইউনূস লন্ডন সফরে রয়েছেন। কিন্তু বিবিসি বাংলা বলছে -এটিকে সরকারি সফর বলা হলেও সফরের মূল আকর্ষণ হয়ে উঠেছে কিংস চার্লস হারমনি অ্যাওয়ার্ড গ্রহণ।
এরইমধ্যে জানানো হলো, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার কানাডায় অবস্থান করছেন এবং সে কারণে ইউনূসের সঙ্গে তাঁর কোনো সাক্ষাৎ হবে না। অথচ বৃটেনের প্রভাবশালী পত্রিকা Financial Times শিরোনাম করল—
"Keir Starmer declines to meet Bangladesh leader tracking down missing billions!" এর মাধ্যমে যেন অকপটে বলে দেওয়া হলো -কিয়ার স্টারমার আমাদের প্রধান উপদেষ্টাকে গুরুত্বই দিচ্ছেন না।
ওই প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, লন্ডনে সফরত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাতের অনুরোধে সাড়া দেননি যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে পাচার হওয়া কয়েক বিলিয়ন ডলার উদ্ধারের প্রচেষ্টায় বৃটেন সরকারের জোরালো সমর্থন আদায়ের প্রেক্ষিতে স্টারমারের সঙ্গে সাক্ষাতের কথা জানায় বাংলাদেশ। তবে তাতে সাড়া দেননি স্টারমার।
গণমাধ্যমটিকে দেওয়া সাক্ষাতকারে প্রফেসর ইউনূস বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া বিপুল পরিমাণ অর্থ উদ্ধারে সহযোগিতা করা বৃটেনের ‘নৈতিক দায়িত্ব’। কেননা পাচার হওয়া ওই অর্থের বেশির ভাগই বৃটেনে রয়েছে। তবে ড. ইউনূস বলেছেন, এখনও এ বিষয়ে সাক্ষাৎ করতে রাজি হননি স্টারমার। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, তাঁর (বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী) সঙ্গে আমার সরাসরি কোনো আলোচনা হয়নি। তবে স্টারমার বাংলাদেশের পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারে সমর্থন করবেন বলে আশা ব্যক্ত করেছেন তিনি। ড. ইউনূস বলেন, ‘এগুলো চুরির টাকা।’
প্রশ্ন ওঠে -কেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান একটি বৈধ রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পারস্পরিক স্বার্থ ও বোঝাপড়ার আলোচনায় বসতে পারেন না? কেন সরকারিভাবে এত ঢাকঢোল পেটানো হলো, অথচ পরিণামে এই লজ্জাজনক প্রত্যাখ্যান? প্রেস উইং কেন একের পর এক বিভ্রান্তিকর বার্তা ছড়ালো? অথচ আমাদের দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ সত্যিকার অর্থেই আমাদের কোষাগারে জমা হওয়াটা খুব জরুরি।
আমরা জানি, নাৎসি জার্মানির প্রোপাগান্ডা মন্ত্রী জোসেফ গোয়েবলস আত্মহত্যা করেছিলেন। কিন্তু তিনি যে ‘নব্য শোয়েবলস’ হয়ে আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রচারযন্ত্রে পুনর্জন্ম নেবেন -তা কে ভেবেছিল?
প্রধান উপদেষ্টার মতো একজন বিশ্বব্যাপী পরিচিত ব্যক্তিত্বকে এইভাবে উপেক্ষিত হতে দেখাটা শুধু দুঃখজনক নয়, বরং কূটনৈতিকভাবে অত্যন্ত লজ্জার। আর এটি যে শুধু ব্যক্তিগত অপমান নয়, রাষ্ট্রেরও মর্যাদার হানি -সেটি বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছে সরকারের মুখপাত্র ও কূটনৈতিক পরামর্শকরা।
গেল বইমেলায় গণরোষে পরাজিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুখাঙ্কিত ডাস্টবিন বানিয়ে, তাতে ব্যবহৃত টিস্যু ফেলে জুলাই আন্দোলনকারীদের বাহবা কুড়াতে চেয়েছিলেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। এবার লন্ডনে সেই শফিকুল আলমের পাশে প্রফেসর ইউনূসের মুখ সম্বলিত ডাস্টবিন বানিয়ে ময়লা ফেলছে প্রবাসী আওয়ামী লীগ। পরস্পরের এমন প্রতিশোধমূলক অপমানযজ্ঞে বিব্রত হচ্ছে বাংলাদেশ।
আমরা বিশ্বাস করি, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের মতো নোবেলজয়ী একজন বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্বের সঙ্গে এমন আচরণ তাঁর প্রাপ্য হতে পারে না। কিয়ার স্টারমারের নীরবতাও এই প্রতিভাধর ব্যক্তির প্রতি অশোভন। কিন্তু তার চেয়েও বেশি দুঃখজনক -প্রফেসর ইউনূসের আশপাশের লোকজন যেভাবে তাঁকে ভুল বার্তা ও কৃত্রিম সম্মানের আড়ালে বিপজ্জনক নিঃসঙ্গতায় ঠেলে দিচ্ছেন সেটি। তাঁরা বুঝতে পারছেন না -দেশের মাথা উঁচু করতে গিয়ে তাঁরা মাথার ছায়াটুকুও লোপাট করে ফেলছেন।
লেখক: সাংবাদিক
১২ জুন ২০২৫