
পর্ব- ২: বাসনার সেই নদীতীরে
সারাদেশে তখন জঙ্গি হামলার উৎপাত। লাইব্রেরি থেকে শুরু করে শপিং মল সবখানে ব্যাগ পকেট চেক করে তারপর ঢুকতে দেয়। কখন কোথায় বোমা পড়ে এই ভয় একটু হলেও সবার মনেই । এর মধ্যে মাসের প্রথম সোমবার বাঘমারা থেকে এক ছাত্র এসে উঠল আমার পাশের রুমে। চাহনি কেমন খালি খালি, আমার বেশিরভাগ কথার উত্তরও দিল না। তাই ডাইনিং স্পেসে ব্যাগ রেখে ছেলেটা বাইরে চলে যেতেই, ভীতি অথবা সাহসের তাড়নায়, আমি তার ব্যাগ দুইটা ধরে দেখলাম। একটার ভেতরে মনে হলো ছোট ছোট বহু কৌটা জমানো। ডেনিম ব্যাগ আর ট্রাঙ্কে দেখলাম খুব দামি তালা ঝুলছে। সন্দেহ আরো ঘন হলো, যখন ট্রাঙ্কটা তুলতে গিয়ে দেখি অস্বাভাবিক ভারি।
হোস্টেলের কাউকে কিছু না বলে, তৎক্ষনাৎ আমি রিকশা নিয়ে চলে গেলাম পাঠানপাড়া। থামলাম রিপোর্টার গলিতে। যাঁর কারণে রাস্তার এই নাম দরজা খুলে দিলেন তিনি নিজে। হাঁপাতে হাঁপাতে তাঁকে কতখানি কী বললাম পরিস্কার মনে করতে পারি না। রিপোর্টার সাহেব আমাকে তারপর ফোনে কথা বলিয়ে দিলেন নগর পুলিশের সবচেয়ে বড়ো অফিসারের সাথে। আমাকে বলা হলো রাত দেড়টায় অভিযান। আমি যেন উপস্থিত থেকে সহযোগিতা করি। তবে ঘুনাক্ষরেও আর কোনো মানুষ যেন টের না পায়, এমনকি আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুরাও না।
পুলিশ এসেছিল নির্ধারিত সময়ের মিনিট বিশেক আগেই। আমি বাদে প্রায় সবাই ততক্ষণে হয় ঘুম না হয় পড়াশোনায় ব্যস্ত। গাড়িবহরের শব্দ, বুটের আওয়াজ আর দরজায় তীব্র করাঘাত আমার কানেই বলাবাহুল্য প্রথম এলো। দুরু দুরু মন নিয়ে দরজা খুলতেই একটা অত্যাধুনিক বন্দুকের নল দেখলাম সোজা আমার কলিজা বরাবর তাক করা।
আজকে হোস্টেলে ফিরে অসহায়ের মতো কেবল ঘড়ি দেখছি বার বার, চোখে বিন্দুমাত্র ঘুম নাই। দুইটার একটু আগে ঝমঝম করে বৃষ্টি নামলো। ওয়াকম্যান আর হেডফোনটা নিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। নতুন ক্যাসেটগুলো থেকে একটা একটা করে গান শুনছি। আমাদের নিচতলার বারান্দায় দাঁড়ালে তিনটা রঙিন পোস্ট বক্স দেখা যায়। দুয়েকজন কালেভদ্রে খামও ফেলে এদের ভেতরে। বক্সগুলো দেখলে কোনো একজনকে চিঠির পর চিঠি লিখে উত্তর না পাওয়ার রাগ এসে আমার মাথায় পোড়া কাঠ হয়ে জ্বলতে থাকে। ওইদিকে যত পারি, তাই কম তাকাই। আজকে এড়াতে পারলাম না, বার বার চোখ চলে যাচ্ছে। আর কানে বেজে চলেছে অন্তর থেকে অন্তরের দূরত্ব নাই করে দেয়ার বাসনা জাগানো সুর। বিরহে ভেঙে পড়া শরীরে আশ্বাস হয়ে বাজছে শীতল প্রেম-কাহিনী।
যখন দখিন বাতাস গায় পরশ বুলাবে এসে
জেনো এসে গেছি আমি অবশেষে
বাসনার সেই নদীতীরে
খোলা বুকে উত্তরের বাতাস বিঁধছে কাঁটার মতো। পায়ের নিচে মাতাল পৃথিবী বিরতি-বিহীন দুলছে। বিরহের নেশা সবসময় তীব্রতর, বিচ্ছেদের ভয় বন্দুকের নলের চেয়েও হিংস্র হয়ে উঠতে পারে যখন তখন। অপার্থিব কন্ঠ-ভেজা গানটার প্রভাবেই বোধহয়, পোস্ট অফিসের সামনের রাস্তা হয়ে যাচ্ছে ঘোলা নদী। ঢেউয়ের শব্দে মুখর হয়ে আবছা আলোয় দেখলাম একটা হুডতোলা রিকশা ছুটে আসছে। বারান্দার সামনে নামলো তার সিক্ত সওয়ারি। খয়েরি চাদরে লেপ্টে আছে ভেজা চুল। হাতে কাচের চুড়ি। বুকে চেপে রাখা রজনীগন্ধার সাথে হেসে সে মিশে যাচ্ছে অভিসারের ঘুর্ণিস্রোতে।

মানুষ ভাবতে, লিখতে এবং বলতে ভালোবাসে তারা পৃথিবীর দীর্ঘ জলস্রোতগুলোকে অসংখ্য সুন্দর নাম দিয়ে ধন্য করেছে। যমুনা, টেমস, ব্রহ্মপুত্র, ভোলগা, মহানন্দা, সিন্ধু, জর্ডান, অ্যামাজন, ধানসিঁড়ি, নীল, গঙ্গা, সুরমা, রাইন, দজলা, সোমেশ্বরী। কিন্তু এই নামগুলোর কোনো প্রয়োজন নদীরা কোনদিন বিন্দুমাত্র অুনভব করে নাই। মানুষের ভাষা, শব্দ, উচ্চারণে তৈরী এই নামগুলোকে আদতে তারা উপেক্ষা এবং অবিশ্বাস করে এসেছে যুগের পর যুগ।
বরং দেখা গেছে শ্রুতিমধুর নামগুলো ধীরে ধীরে জৌলুস হারায়। কেবল নদীর নাম হয়ে বেঁচে না থেকে, বছর বছর নতুন করে তাদের জন্ম হয়। বেড়ে উঠতে থাকে ভাত-রুটির হোটেল, কোচিং সেন্টার, ফটোকপির দোকান, শপিং মল ইত্যাদি বিচিত্র পরিচয়ে। সমুদ্রগামী জলের ধারাগুলো এভাবে নামের মালিকানা, গৌরব হারিয়ে বহুবার আহত ও ক্ষুব্ধ হয়েছে।
তারা মানুষের চোখ, চুল, হাতের দিকে চেয়ে থাকে যতবার, যখনই সম্ভব। বাতাস, ঢেউ, বালু, জল— যত উপায়ে সম্ভব— মানুষকে জানাতে চায় প্রচণ্ড গুরুত্বপূর্ণ এক সত্য। এই গ্রহের সব গতিময় জলরাশি আসলে একাকার, সবাই আসলে একজন। তাদের তাই কোন অজুহাতেই আলাদা নামের প্রয়োজন নাই। এমনকি নদও যা, নদীও তাই। আর পুরো দুনিয়াতে মূলত একটাই নদী-তীর। এর শুরু থেকে শেষ, আবার শেষ থেকে শুরু। এপার-ওপারের খেলাও শেষমেশ মানবসৃষ্ট মোহ কেবল। একূল ওকূল পারাপার বলতে মানুষ যা বোঝে, নদী তা স্বীকার করে না। পাড় ভেঙে, পলি ঢেলে, ভাসিয়ে এবং ডুবিয়ে দিয়ে নদী যে দরকারি আলাপটুকু করতে চায়, মানুষ তা ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায় এক অক্ষরও বুঝতে পারে না।
এই যে পুরো দুনিয়াতে কেবল একটাই নদী-তীর, তাঁর কোন এক নাতিশীতোষ্ণ বাঁকে আমাদের সুর-সচেতন ছোট্ট স্বাধীন রাজ্য। ক্ষুদ্র আয়তন হলেও, মানুষ অনেক। অভাব অভিযোগও বেশি। কিন্তু এখানে জনগণ যে যার মতন শৌখিন। গান-বাজনা নিয়ে প্রায় সবাই অল্পবিস্তর জ্ঞান রাখে। উদাসি সুর, কবিতার বাণী আর মোহময় কণ্ঠের কদর সবচেয়ে বেশি। ভালো গানের কোনও হিসাবও কেউ রাখেনা, এতো অসংখ্য রকম সুর ছড়িয়ে আছে দশ দিগন্তে। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শুরু করে ব্যস্ততম রাজধানী, সঙ্গীত নিয়ে হাজার রকম আয়োজন চলে ছয় ঋতু, বারোমাস। রেডিও টেলিভিশন ম্যাগাজিনে গায়ক গায়িকাদের দাপুটে পদক্ষেপ চোখে পড়ার মতো। এবং সবচেয়ে জমজমাট যজ্ঞ শুরু হয় রাজ্যটির বয়স প্রায় ষোলো বছর পূর্ণ হলে।
কার্তিক মাসের মাঝামাঝি, রাত সাড়ে দশটা মানে তাই হালকা শীতল বাতাস আর নতুন কুয়াশা। শহুরে, গ্রামীণ সমস্ত রাস্তাঘাট জনশূন্য। কোটি কোটি চোখ বরং চেয়ে আছে কয়েক লক্ষ টিভি পর্দায়। গ্রামীণ উঠান, চায়ের দোকান, নাগরিক বৈঠকখানা, ক্লাবঘর, মেলার মাঠ। কোথাও রঙিন কোথাও সাদাকালো। সবাই এক রাজকীয় অভিষেক উপভোগের অপেক্ষায় আকুল হয়ে আছে। চাঁদ তারায় আকাশ ঝলমল করছে। জমিনে হেমন্তের ঘাস-গুল্মে ফুটে আছে মন উচাটন ফুল। সব ছাপিয়ে এক সুরের সুলতানার গীতিময় নাম ভেসে উঠলো প্রথমে মাতৃভাষায়, তারপর ইংরেজি অক্ষরে। কেঁপে উঠলো পাদপ্রদীপ। মঞ্চে মিশে আছে সূর্যাস্তের রঙ। সাদা পর্দা এলোমেলো হাওয়ার তালে দুলছে। মুহূর্তেই আমাদের মনোযোগী নজরে এসে বিঁধল দ্যুতিময় এক ছায়া। তবলার হালকা তালে এগিয়ে এসে গানের রানি দাঁড়ালেন ঠিক প্রদীপের মধ্যখানে। আর ভেসে আসলো তাঁর ভুবনভুলানো আওয়াজ। সোনালি পাড়ের কাতান শাড়ি গায়ে সুরসম্রাজ্ঞী গাইতে শুরু করলেন গাঢ় কবিতায় বসানো এক নজিরবিহীন সুর।
বাসনার সেই নদীতীরে
চিনে নিও প্রিয় সাথীরে
স্বপ্ন ভেবে কেঁদোনাকো বেদনাতে
যখন থামবে কোলাহল
ঘুমে নিঝুম চারিদিক
জমকালো আয়োজনটি করা হয়েছিল প্রতিবেশি সাত রাজ্যের সম্মিলনে। এই সাত ভূখণ্ডে এমনিতে সুর নিয়ে অলিখিত যুদ্ধ চলে বারোমাস। এদের মধ্যে তিন দেশ কয়েক দশক আগেও এক ছিল। সুরের রাজধানী ছিল তখন আরব সাগর ঘেরা জনাকীর্ণ এক শহরে। বলতে গেলে সেই সময় থেকেই নারী-শাসনে অভ্যস্ত এই তিন রাজ্যের সুর-পিপাসু বিচিত্র জনগণ।
চলবে…