ভাঙা ডানার উড়ান,
অধ্যায় ১: অভিশপ্ত শৈশব
সুপ্রভা।
নামটা তার দাদু রেখেছিলেন—যেন মেয়েটার জীবনে প্রতিদিন শুরু হয় একটা সুন্দর সকাল দিয়ে।
কিন্তু বাস্তবতা এমন এক বিষাক্ত ঘুম, যার কোনো ভোর হয় না।
সে জন্মেছিল একদম স্বাভাবিক শরীরে। হাঁটত, দৌড়াত, খিলখিল করে হাসত।
কিন্তু সাত মাস বয়সে একদিন গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে টিকা নিতে গিয়েছিল সে। তখন কেউ বুঝত না, না বুঝেই টিকা দেওয়া হতো। সেই রাতেই শুরু হয় জ্বর। তারপর হাত-পা কাঁপুনি। আর উঠল না সে নিজের পায়ে।
ডান পা, তারপর বাম পা—দুইটাই হারিয়ে গেলো এক অদৃশ্য যন্ত্রনার গ্রাসে।
গ্রামের লোকেরা বলত,
— “ওর ওপর যাদু টোনা করা হয়েছে।”
তার মা চোখের জল মুছে বলত,
— “আমার গর্ভের কলঙ্ক... ও জন্মেই আমার পাপ প্রকাশ করল।”
সাত ভাইবোনের মধ্যে সুপ্রভা ছিল চতুর্থ। কিন্তু তাকে কেউ ভাইবোন বলে স্বীকার করত না।
তাদের ছোট টিনের ঘরে বৃষ্টির দিনে ছাউনি চুঁইয়ে পড়ে বালিশ ভিজে যেত, আর শীতে তার শরীর ঢাকার মতো কিছুই থাকত না।
বাবার ছেঁড়া লুঙ্গি দিয়েই সে শরীর মুড়ত।
শীত কাঁপিয়ে দিত হাড়, কিন্তু ঘরের এক কোণে বসে থাকা প্রতিবন্ধী মেয়ের জন্য চুলার আগুন কখনো আলাদা জ্বলেনি।
তার বাবা—মাছ ধরতেন। কিন্তু মাছ বেচে টাকা আনতেন না। সব শেষ করে দিতেন পান-জর্দা আর দেশি মদের খরচে।
মাঝে মাঝে চিৎকার করে বলতেন,
— “এই মাইয়্যা মরলে আমার ঘরের বোঝা কমত।”
তখন সুপ্রভা তাকিয়ে থাকত বাবার মুখের দিকে,
কিন্তু চোখে পানি আসত না।
সে কান্না ভুলে গিয়েছিল।
সবচেয়ে যন্ত্রণার জায়গা ছিল মা।
একজন মায়ের ভালোবাসাহীনতা পৃথিবীর সবচেয়ে ঠাণ্ডা শীত।
ঈদের দিনে মা অন্য ভাইবোনদের নতুন কাপড় দিত। সুপ্রভা শুধু দেখত।
— “তোর কিসের ঈদ? আল্লাহ তোকে এমনিই শাস্তি দিছে,” বলত মা।
তবুও সে থেমে থাকেনি।
সে শিখে নিয়েছিল—রান্না, কাপড় ধোয়া, কাঁথা সেলাই।
পা না থাকলেও সে হাঁটু দিয়ে ঘরের কাজ করত, ছেঁড়া কাপড় জোড়া দিত।
প্রতিবন্ধী ভাতা থেকে যেটুকু পেত, জমিয়ে রাখত চুপচাপ।
বছর দুয়েক পরে একদিন সেই টাকায় কিনে ফেলল একটা ছাগল।
কেউ বিশ্বাস করল না সে এটা পারবে।
ছাগলটা তার কাছে শুধু একটা পশু নয়—একটা বিজয়ের প্রতীক।
যেন এই প্রথমবার কেউ তাকে না বলেও "তুই পারিস" বলেছে।
তবুও, ঘরের চারপাশের অবজ্ঞা, সমাজের বিষাক্ত চোখ, আর নিজের মধ্যে জমে থাকা শূন্যতা—সব মিলিয়ে সুপ্রভা ছিল একটা জীবন্ত জ্বলন্ত ছাই।
কিন্তু সেই ছাইয়ের ভেতরেই কোথাও লুকিয়ে ছিল একটা জ্যোতি।
একটা আগুন—যা একদিন আলো দেবে।