বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য রুহুল কুদ্দুস তালুকদার (দুলু) নাটোরে গেল ১৬ মার্চ নাটোরে এক জনসভায় দ্রুত জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেওয়ার দাবি তুলে বলেছিলেন, 'প্রয়োজনীয় সব সংস্কার করবে পরবর্তী নির্বাচিত সরকার।' এ দাবির প্রতিধ্বনি শোনা গেছে রুহুল কবির রিজভী আহমেদ ও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কণ্ঠেও বহুবার। প্রশ্ন হলো, পুরনো এই দাবির প্রসঙ্গটি এখন আবার আসছে কেন?
উত্তরটা খুঁজে পাওয়া যায় আজকে লন্ডনে অনুষ্ঠিত একটি বহুল আলোচিত বৈঠক শেষের ঘটনা পরিক্রমায়। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস নিজ উদ্যোগে লন্ডনে গিয়ে বৈঠক করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে। ওই বৈঠকের পরপরই নিজের ঘোষিত এপ্রিল প্রথমার্ধের নির্বাচনী রোডম্যাপ থেকে সরে এসে প্রফেসর ইউনূস সরকার ফেব্রুয়ারিতে ভোট আয়োজনের সম্ভাবনার কথা বলছে -যা মূলত বিএনপির দাবি। এই প্রেক্ষাপটে বলা যায়, রাজনীতির চাকা এখন দৃশ্যত বিএনপির দিকে ঘুরতে শুরু করেছে।
তবে এই ঘটনাকে সবাই ইতিবাচকভাবে দেখছে না। প্রফেসর ইউনূসপন্থী জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বলছে, এই বৈঠক “জুলাই চেতনার” সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক। দলটির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীর ভাষায়, 'একটি দলকে খুশি করার জন্য নির্বাচন এগিয়ে আনা হচ্ছে, যা শহীদদের সঙ্গে প্রতারণা। লন্ডনের বৈঠক দেশবাসীর প্রত্যাশা পূরণ করেনি।'
জাতীয় নাগরিক পার্টির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ ইউনূস-তারেক বৈঠককে স্বাগত জানালেও নির্বাচন প্রসঙ্গে নিজের সোশ্যাল হ্যান্ডেলে লিখেছেন, 'জুলাই মাসের মধ্যে জুলাই ঘোষণা পত্র ও জুলাই সনদ, মৌলিক সংস্কার, দৃশ্যমান বিচার এবং নির্বাচনকেন্দ্রিক প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধন নির্বাচনের পূর্বশর্ত। জুলাই সনদের পূর্বে নির্বাচনের মাস আর তারিখ নিয়ে কথা বলা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান দায়বদ্ধতা ভুলে যাওয়ার নামান্তর। সনদ রচনার পরেই নির্বাচন বিষয়ক আলোচনা চূড়ান্ত হওয়া উচিত।'
অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামীর প্রতিক্রিয়া ছিল ভিন্ন। তারা আগেই ফেব্রুয়ারিতে ভোট দাবি করেছিল। ফলে তারেক-ইউনূস বৈঠককে তারা স্বাগত জানিয়েছে। এই দ্বিমুখী প্রতিক্রিয়া বোঝায়, অন্তর্বর্তী সরকারের নীতিগত অবস্থান এখন একটি অনিশ্চিত দ্বিধাবিভক্তির মধ্যে রয়েছে।
তারেক রহমান প্রায় ১৫ বছর ধরে লন্ডনে নির্বাসিত। রাজনৈতিক ও দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত এই নেতা হঠাৎ করে আবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এলেন। তাকে দেশে ফিরতে কোনো নিশ্চয়তা না দিয়েই প্রধান উপদেষ্টা নিজে গিয়ে সাক্ষাৎ করলেন -এটি নিঃসন্দেহে তারেক রহমানের রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতার বড় স্বীকৃতি। একইসঙ্গে, এটি ইউনূস সরকারের একচ্ছত্র কর্তৃত্বের সীমাবদ্ধতাও প্রকাশ করে।
যে সরকার সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন-এই তিনটি গুরুদায়িত্ব নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে, তাদের প্রধান যখন নিজেই রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য বিদেশযাত্রায় বাধ্য হন, তখন প্রশ্ন ওঠে সেই সরকারের শক্তি ও দৃঢ়তা নিয়ে। এ অবস্থায় বিএনপির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে গিয়ে ইউনূস সরকার নিজের সমর্থিত দল এনসিপি ও জামায়াতের সঙ্গে মনোমালিন্যে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা প্রবল। বিশেষ করে, যদি কাঠামোগত সংস্কার ও বিগত সরকারের বিচার অসমাপ্ত রেখেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তবে সেটি এনসিপি-জামায়াত উভয়ের জন্যই রাজনৈতিকভাবে কম সুবিধাজনক হতে পারে। তারা নির্বাচনের ফেব্রুয়ারি রোডম্যাপ নাও মানতে পারে।
বিএনপির দাবি বরাবরই স্পষ্ট -সংস্কার ও বিচার নির্বাচিত সরকার করবে। ফলে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার প্রক্রিয়া নিয়ে তাদের তরফে বাড়তি কোনো চাপ নেই। কিন্তু আওয়ামী লীগের নিষ্ক্রিয়তা বা নিষিদ্ধাবস্থা দীর্ঘায়িত হলে, তাদের ভোটব্যাংক কোথায় যাবে -সেটি নিয়ে যুগপৎভাবে ভাবতে হবে বিএনপি ও প্রফেসর ইউনূসকে। লন্ডনে প্রফেসর ইউনূস জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হয়নি, নিরাপত্তাজনিত কারণে তাদের কার্যক্রম স্থগিত রাখা হয়েছে।
লন্ডন বৈঠকের তাৎক্ষণিক লাভ যে বিএনপির ঘরেই গেছে, তাতে সন্দেহ নেই। তবে রুদ্ধদ্বার আলোচনা কতদূর গড়িয়েছে, আসন সমঝোতা হয়েছে কি না -তা এখনো অস্পষ্ট। বিএনপি যদি ক্ষমতায় ফেরে, তবুও তাদের জন্য পরিস্থিতি সহজ হবে না। দেশে দীর্ঘ অনুপস্থিতির পর তারেক রহমান যদি সত্যিই নেতৃত্বে আসেন, তিনি কেমন শাসক হবেন -সেটিই বড় প্রশ্ন।
তারেক রহমান অন্তত দেড় দশক ধরে একটি পরিণত গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির দেশে অবস্থান করছেন। প্রকৃত কল্যাণ রাষ্ট্রের সেই অভিজ্ঞতা যদি তিনি কাজে লাগান, তবে তা দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে। জনগণের জন্য সুখকর হবে। কিন্তু যদি ক্ষমতা হাতে পেয়েই তিনি অতীত সরকারের মতো একনায়কোচিত আচরণ শুরু করেন, তবে তাঁকেও নবীন ছাত্র-জনতার প্রতিরোধের মুখে পড়তে হবে।
আমরা প্রত্যাশা করি -দেশের রাজনীতি ভারসাম্য ও গণতান্ত্রিক চর্চার পথে এগিয়ে যাবে। প্রফেসর ইউনূস তাঁর আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা ও নৈতিক বলয় ধরে রেখে দেশকে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দিকে নিয়ে যাবেন -নাগরিক আকাঙ্ক্ষা এটাই।
লেখক: সাংবাদিক
১৩ জুন ২০২৫