সমু চৌধুরীর ঘটনাটা মোটেও দুর্বোধ্য কিছু নয়। সেদিন প্রাতঃস্নান ও প্রার্থনা শেষে, মনের প্রশান্তির খোঁজে তিনি এক কাপড়ে শুয়ে পড়েছিলেন মিসকিন শাহের মাজারের পুরোনো বটগাছের ছায়াতলে। হঠাৎ এক 'ভাইরাল সিকার' সেখানে পৌঁছে ক্যামেরা তাক করল তার দিকে। মুহূর্তে ছবিটি উঠে গেল ফেসবুকে। তারপর তো যা হবার -রটনার ডানায় চেপে খবর ছড়িয়ে পড়ল: “সমু চৌধুরী পাগল হয়ে গেছেন!”
ধরুন, পাগলই যদি হয়ে থাকেন -তাতে আপনাদের ফুটপাত-ভিত্তিক টিকটকারদের সমস্যা কোথায়? সমু চৌধুরী নিজেই কিঞ্চিৎ কৌতুক আর বিস্ময়ে প্রশ্ন রেখেছেন, “এ কীরে! আমার কি স্বাধীনতা নেই দুদণ্ড শান্তিতে ঘুমাবার?” গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, তিনি মাজারের পাগলদের সাথে নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা মিলিয়ে দেখছিলেন। এরপর নিজের স্বভাবসিদ্ধ দার্শনিক ঢঙে প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, “আউলিয়া-দরবেশ চেনো না তোমরা?”
আমরা আদৌ কাউকে চিনি না। বরং, এখন এক নতুন প্রজাতির মানুষের উদ্ভব ঘটেছে -যারা নিজের ছায়া ছাড়া আর কাউকে চেনে না, মানতেও চায় না। মধ্যপ্রাচ্য যখন বহুচর্চিত কট্টরপন্থার ধর্মীয় বিভ্রান্তি ত্যাগ করে উদারতার পথে ফিরছে, তখন আমাদের দেশে কিছু মানুষ ফেলনা হয়ে পড়া ওই একপেশে তরিকার ধ্বজা তুলে সাধারণ মানুষের মগজ মটকাতে ব্যস্ত। ইতোমধ্যে এই প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী দেশের কয়েক শত মাজার গুড়িয়ে দিয়েছে।
যে শাহজালাল, শাহ পরান বাংলার মাটিতে ইসলামের প্রচার-প্রসারে ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছেন, সেই দরবেশদের স্মৃতিচিহ্ন, অনুসারী ও আশ্রয়স্থল -সবকিছু তারা নিঃশেষ করে দিতে উঠে পড়ে লেগেছে। তাদের চোখে সমু চৌধুরীর মতো আত্মভোলা মানুষ ‘ধর্মহীন’, অচ্ছুত। কেবল তারাই নাকি ধর্মের আসল ও একমাত্র উত্তরাধিকারী -স্বর্গের টিকিটও কেবল তাদের পকেটে।
তাহলে প্রশ্ন করি, পাগলেরা কি তাদের সেই স্বর্গে যেতে চেয়েছে?
তাদের কি আদৌ কোনো আগ্রহ আছে সেখানে ঢোকার?
সমু চৌধুরী যা বলতে চেয়েছেন, তা মূলত একটিই কথা -প্রত্যেকেরই নিজস্ব ধ্যান, ব্রত, সাধনার পথ থাকে। তাকে সে পথে হাঁটতে দাও। একজন মানুষ যদি মাজারের ছায়ায় একটু ঘুমিয়ে স্বস্তি পায়, তাহলে তার সেই ব্যক্তিগত মুহূর্তকে কেন জনতার বিদ্রুপে পরিণত করা হবে? কেন সেই অনুভবকে পিষে ফেলা হবে আরোপিত ধর্মীয় জিগিরের পায়ে?
আমরা চাই না, এমন আত্মমগ্ন শিল্পীর পেছনে টিকটক মিডিয়ার বেহুদা তামাশা লেগে থাকুক। তার নিজের ভুবনেই থাকুক সে, নিজের মতো করে। যে মানুষ নিজেকে বোঝে, সে-ই অন্যকে ভালোবাসতে জানে।
নদীয়ার নবীন গোরা লালন ফকির যেমনটা বলেছিলেন:
"মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি,
নইলে ক্ষ্যাপারে তুই মূল হারাবি!"
লেখক: সাংবাদিক
১৩ জুন ২০২৫