বাংলাদেশের গণমাধ্যম সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম ইমোশন ও সেন্টিমেন্ট নিয়ে খেলে। সবটাই দু'চার পয়সা রোজগারের বাহানা। ওরা দিনে ডজন ডজন কন্টেন্ট তৈরি করে বলে দিচ্ছে ইম্পেরিয়ালিস্টদের শেষ করে দেয়ার পথে আছে ইরান। কিন্তু বাস্তবতা টোটালি ভিন্ন। একরাতের হঠাৎ অতর্কিতে হামলায় 'ই' আদ্যাক্ষরের দেশটি ইরানের শীর্ষ সামরিক কমান্ডার এবং শ্রেষ্ঠ পরমাণু বিজ্ঞানীদের খতম করে দিয়ে এসেছে। খোমেনির ধর্মীয় কট্টরপন্থা বিশিষ্ট এই মানুষদের প্রাণ বাঁচাতে পারেনি। কিন্তু আমাদের মিডিয়ায় ইরানের এই করুণ পরিণতি না দেখিয়ে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে ইরানকেই বিজয়ীর আসনে বসানো হয়।
এমনকি ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা ইরনাসহ সেদেশের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত কোনো মাধ্যমের খবরই বিশ্বাস করবার জো নাই। বিশ্বাস করা যাবে না 'ই' দেশের হায়োম বা হারেৎজ মিডিয়ার খবরও। যে যার দেশের পক্ষে ইনিয়ে বিনিয়ে বেখবরটাই বেশি বলবে তারা।
চোখ রাখতে হবে আল জাজিরা, বিবিসি, ডয়েচে ভেলে এবং জাপানের এনএইচকে মিডিয়া। তারা ঘটনাস্থল থেকে প্রতিনিয়ত মধ্যপ্রাচ্য সংকটের চুলচেরা বিশ্লেষণ করছে।
ইতিহাস আমাদের শেখায় -বিপ্লব সবসময় মুক্তি আনে না। কখনও কখনও তা নতুন ধরনের দাসত্ব তৈরি করে। আমরাও গেল জুলাইতে 'ইনক্লুসিভ' বাংলাদেশের কথা বলেছিলাম। বাস্তবতা হলো জুলাই চেতনার ধ্বজাধারী হয়ে কেবল একশ্রেণীর মানুষ নিজেদের সালতানাত তথা রাজত্ব কায়েম করতে চাইছে। যেখানে তারা ছাড়া ভিন্ন মতাদর্শের মানুষদের কোনো জায়গা হবে না।
১৯৭৯ সালের ইরানকে মনে করুন। মানুষ রাজতন্ত্র থেকে মুক্তি চেয়েছিল। রাজা শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভির অধীনে আধুনিক জীবনধারায় অভ্যস্ত শহরবাসী, নারীর স্বাধীনতা, শিল্প, সাহিত্য, সিনেমা -সব ছিল। কিন্তু ছিল ভিন্নমতের প্রতি দমন-পীড়ন, দুর্নীতি ও বৈষম্য। তাই আয়াতুল্লাহ খোমেনির ডাককে মানুষ বিপ্লবের ডাক ভেবেছিল। কিন্তু কী হলো তারপর?
শাহ গেলেন, এল “ইসলামী প্রজাতন্ত্র”। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা গেল, নারীর অধিকার গুঁড়িয়ে গেল। নারীর অবগুণ্ঠন বাধ্যতামূলক হলো। শিল্প-সাহিত্য সেন্সর হলো। নৈতিক পুলিশ চালু হলো। ‘শত্রু’ খুঁজতে খুঁজতে দেশের তেল বিক্রি করা অর্থে ‘বন্ধু প্রতিপালনের নামে' চারিধারে যুদ্ধবাজদের প্রমোট করতে ব্যস্ত হলো রাষ্ট্র। আর এভাবে ইরান পশ্চিম-বিরোধিতার নামে নিজের জনগণেরই সবচেয়ে বড় শত্রুতে পরিণত হলো। এখন সেই বিপ্লবের সন্তানরাই বলছে, "আমরা বিপ্লব চাই না, স্বাভাবিক জীবন চাই।"
সাম্প্রতিক ঘটনা আরও ভয়ানক। যুদ্ধবিমানের বহর, ড্রোনের ঝাঁক, ১৭০০ কিমি দূর থেকে ছোড়া মারণাস্ত্র, এক রাতে খতম প্রায় পুরো সামরিক নেতৃত্ব। 'ই'দের হামলায় উল্টে গেল ইরানের ক্ষমতার বোর্ড। কিন্তু কেউ পাশে নেই, এমনকি সেই মানুষগুলোও না, যাদের রক্তের বিনিময়ে এই “ইসলামী বিপ্লব” এসেছিল। কারণ কী? কারণ একটাই: বিপ্লবের নামে বিশ্বাসঘাতকতা। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন-সাধকে ব্যবহার করে ক্ষমতা দখল। ধর্মের নাম করে গলা টিপে ধরা গণমানুষের স্বাধীনতা।
ইরানের মতো ভবিষ্যৎ আমরা চাই না। আমরা চাই -গণতান্ত্রিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক, উদার, মানবিক ও মুক্ত বাংলাদেশ। বিজ্ঞানমনস্ক যে বাংলাদেশ বিশ্বের সবদেশের সমান মর্যাদায় বিশ্বাসী হয়ে নিজের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা রক্ষা করবে। আমরা কাউকে শত্রু বানিয়ে নিজেদের পায়ের তলার মাটি যেন হারিয়ে না ফেলি।
ইরানি সাহিত্যিক ও দার্শনিক হাফিজ, ফেরদৌসী, শেখ সা’দি, রুমি ও ওমর খৈয়ামের সাহিত্যসম্ভার, আব্বাস কিয়ারোস্তামি, মাজিদ মাজিদি ও আসগর ফরহাদির চলচ্চিত্র আমাদেরকে মহত্তম উপলব্ধিতে ঋদ্ধ করে। কিন্তু এইসময় একজন হাফিজ কিংবা আব্বাস কিয়ারোস্তামি আর জন্মাবেন না। কারণ তাদের মুক্তমত চর্চার পথ রুদ্ধ করে রেখেছে বর্তমান সরকার।
ইরানের মজলুম সাধারণ মানুষের প্রতি আমাদের সহমর্মিতা ও সমর্থন রয়েছে। আমরা চাই ইরান তার অতীত খুড়ে প্রতিবেশির সাথে মানবিক মিত্রতার পথ খুঁজুক। শাসকের গোঁয়ার্তুমিতে ইম্পেরিয়ালিস্টদের হামলার লক্ষ্যবস্তু কেন হবে ইরানের সুন্দর সহজ গণমানুষ?
লেখক: সাংবাদিক
১৪ জুন ২০২৫