মানাফের জন্ম হয়েছিল এক শীতল বিকেলে। সবার মতো তার জীবনও শুরু হয়েছিল নিঃসন্দেহে স্বাভাবিকভাবে। কিন্তু স্বাভাবিকতা কখনোই স্থায়ী হয় না। বাবা মারা যায় তার বয়স যখন সাত, মা যখন ক্যান্সারে মারা গেলেন তখন সে বিশ্ববিদ্যালয়ে।
ঢাকা শহরের ব্যস্ততা থেকে পালিয়ে সে ফিরে এল তার পৈতৃক গ্রামে—পুবাইলের ধুলোবালিতে ভরা ছোট্ট এক গ্রাম যেখানে সন্ধ্যার পর হাঁটার মানুষও চোখে পড়ে না। মানাফ সেখানে ফিরে গিয়ে বাসা বাঁধল তার পুরনো বাড়িতে—রজনী কুঞ্জ।
প্রথম কয়েকমাস সে শান্তিতে কাটাল, দিনের বেলা স্কুলে পড়াত, রাত হলে বই পড়ে ঘুমিয়ে যেত। কিন্তু তারপর থেকেই বদলাতে লাগল তার চারপাশ।
রাত তিনটার ডাক
প্রথম যেদিন সেই ‘ডাক’ শুনল, রাত তখন তিনটা ঠিক। শীতকাল বলে বাতাস কাঁপিয়ে দিচ্ছিল জানালার কাঁচ। সেই রাতে হঠাৎ করে কানে এল গলা—
মানাফ... দরজাটা খোলো...
চমকে উঠল সে। কে? কিন্তু চারপাশে কেউ নেই।
রাতের অন্ধকারে তার জানালার বাইরে যে বাড়িটা দাঁড়িয়ে—সেই পরিত্যক্ত ‘সায়রা মঞ্জিল’—সেই দিকেই তাকাল সে। ওখানে কেউ থাকে না। তবুও শব্দটা আবার এল।
“দরজাটা খোলো…”
সায়রা মঞ্জিলের ইতিহাস....
সায়রা মঞ্জিলের কাহিনি দীর্ঘ। একসময় এই বাড়ির মালিক ছিলেন সায়রা ইমতিয়াজ। বহু বছর আগে তিনি নিখোঁজ হয়ে যান। অনেকে বলত, তিনি কালো জাদু করতেন। তার ঘরে এক ‘নীল দরজা’ ছিল, যেটার কথা কেউ বলতে চাইত না।
বলা হয়, যে সেই দরজায় একবার চোখ রাখে, তার মধ্যে কিছু একটা ঢুকে যায়। সে পাল্টে যায়, আর কখনো আগের মতো থাকে না।
এক রাতে মানাফ আর থাকতে পারল না। সে গেল সেই বাড়িতে। সায়রা মঞ্জিল এখনো দাঁড়িয়ে, যেমন ছিল বিশ বছর আগে—ধূলি জমা বারান্দা, পচা কাঠের দরজা, আর মাঝখানে সেই নীল দরজা।
দরজাটা অদ্ভুত। যেন একটা আয়না, আবার যেন গাঢ় নীল রঙের কুয়াশা।
হঠাৎ করেই দরজার ভেতর থেকে ছায়া ভেসে এল। একজন নারী। গা-ঢাকা কালো কাপড়, মুখ ঢাকা, কেবল চোখজোড়া দেখা যাচ্ছে।
"তুমি ফিরেছো... আমি জানতাম তুমি আসবে..."
মানাফ বলল, “তুমি কে?”
"আমি সেই ইলা... যাকে কবর দেওয়া হয়নি। যার আত্মা আটকে গেছে এই দরজার ওপারে।"
এরপর থেকে প্রতিদিন সেই দরজা খুলে যেতে লাগল মানাফের জন্য। সে কথা বলত ইলার সাথে। কেউ বিশ্বাস করত না। বন্ধুরা ভাবত, সে পাগল হয়ে যাচ্ছে।
সাফওয়ান একদিন এসে জিজ্ঞাসা করল, “তুই কার সাথে কথা বলিস, মানাফ?”
সে বলল, “যে আমাকে ভালোবাসে, তার সঙ্গে। তোরা বুঝবি না।”
কিন্তু একদিন সাফওয়ান নিজে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তার চোখের সামনে দরজাটা হঠাৎ খুলে গেল, ভিতর থেকে ভেসে এল চিৎকার:
"তুমি চলে যাও... সে এখন আমাদের...!"
ভয়ে পেছন ফিরে দৌড় দিল সাফওয়ান। পরদিন গ্রামে গুজব রটে, “মানাফ আত্মা নিয়ে খেলছে। ওর শরীরও এখন ওর নিজের না।”
মানাফ জানল, ইলা শুধু গৃহকর্মী ছিল না। সে ছিল সায়রা ইমতিয়াজের শিষ্যা। তারা মিলে এক তন্ত্রবিদ্যার চর্চা করত—এক বিদ্যা, যেখানে আত্মা বন্দি করে রাখা যায় চিরকাল।
কিন্তু একদিন ইলা প্রেমে পড়ে যায়। আর এই প্রেম ছিল নিষিদ্ধ। সায়রা ঈর্ষান্বিত হয়ে ইলাকে উৎসর্গ করে কালো বিদ্যায়—তার আত্মা আটকে ফেলে সেই নীল দরজার ভেতরে।
সেই প্রেমিক আর কেউ ছিল না... মানাফ নিজে।
তখন সে ছিল অন্য নামে, অন্য পরিচয়ে। জন্মান্তরের কাহিনি!
ইলা বলল—
"তুই বারবার ফিরেছিস, মানাফ। প্রতি জন্মে। কিন্তু আমার মুক্তি হয়নি। এইবার মুক্ত কর, আমায় নিয়ে যা এই বন্দিদশা থেকে।"
মানাফ চিন্তায় পড়ে গেল। যদি এটা সত্যি হয়? যদি ওর আত্মাও বন্দি হয় ইলার সঙ্গে? সে কি চিরতরে হারিয়ে যাবে?
সে বই পড়ে, পুরনো তন্ত্রগ্রন্থ খোঁজে। জানতে পারে, মুক্তির উপায় একটাই—একজনকে দিতে হবে সম্পূর্ণ আত্মা, নিঃস্বার্থভাবে।
এক রাতে, পূর্ণিমার আলোয়, মানাফ ইলার সামনে দাঁড়াল।
“আমি এসেছি। আমি দিতে এসেছি আমার সবটুকু। কিন্তু এক শর্তে—তুমি এই দরজাটা চিরতরে বন্ধ করে দিবে। আর কেউ যেন না হারায় এই রহস্যে।”
ইলা চোখ ভিজিয়ে বলে, “তুমি জানো এর মানে? তুমি বাঁচবে না।”
মানাফ হাসে, “কিন্তু তুমি তো বাঁচবে। আমি তো প্রেম করেছিলাম... এক জীবন নয়, শত জীবন ধরে…”
তারপর নীল দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মানাফ বলল—
“আমি তোর…”
আর কোনো শব্দ নেই। চারদিক আলোয় ভরে যায়, তারপর—অন্ধকার।
২৫ বছর পর…
এক তরুণ ছেলেকে গ্রামে দেখা যায়, নতুন শিক্ষক হিসেবে এসেছে। নাম—রাফিদ। তার স্বপ্নে বারবার আসে এক দরজা, নীল রঙের, এক নারী—যার চোখে যেন চেনা গভীরতা।
লোকজন বলে, রজনী কুঞ্জ আর সায়রা মঞ্জিল এখন ভাঙা পড়ে আছে। কিন্তু মাঝেমধ্যে রাত তিনটায় কুয়াশার ভেতর দিয়ে ভেসে আসে একটি গান:
“তুই ফিরবি… আবার… তুই আমার…”
রাফিদ জানে না কেন, কিন্তু সায়রা মঞ্জিল নামটা তার কানে অস্বস্তি আনে।
যেদিন প্রথম স্কুলে যোগ দিল, সেদিনই পথ ভুল করে গিয়ে পৌঁছে গেল একটা ধ্বংসাবশেষের সামনে—ঝোপঝাড়ে ঢাকা, ভাঙা জানালা, পোকায় খাওয়া দরজা, আর সবকিছুর মধ্যখানে একটা নীল রঙের দেয়াল, যেখানে একটা দরজার অবয়ব এখনো টিকে আছে।
সে অবাক হয়ে দেখে—কেউ যেন ভেতর থেকে তাকিয়ে আছে।
সে চোখ দুটো—চেনা, অথচ অজানা।
সেদিন রাতেই সে প্রথম স্বপ্ন দেখে।
সাদা ধবধবে চাঁদের আলোয় ভেসে থাকা একটা জায়গা, আর সেখানে এক নারী—চুল খোলা, চোখে বিষাদ।
নারীটি বলে—
“তুমি ফিরেছো… কিন্তু ভুল করে ফিরেছো। আমাকে নয়, এবার তোমাকে নিজেকে মুক্ত করতে হবে।”
রাফিদ ঘুম থেকে জেগে উঠে চিৎকার করে। ঘামে ভিজে গেছে।
কিন্তু ঘরের কোণায়, এক ছায়া যেন মিলিয়ে যায় ধোঁয়ার মধ্যে।
অতীতের টুকরো ফিরে আসে
দিন যত যায়, রাফিদের ভেতরে এক অদ্ভুত বদল আসে।
সে স্কুলে পড়ায়, হাসে, গল্প করে… কিন্তু রাত নামলেই সে ছাদে উঠে তাকিয়ে থাকে সায়রা মঞ্জিলের দিকে।
কেন? সে জানে না।
একদিন সে পুরনো এক ডায়েরি খুঁজে পায় স্কুল লাইব্রেরিতে। কাভারে লেখা—
রজনী কুঞ্জ – মানাফ”
সে ডায়েরি খুলতেই চোখ বড় হয়ে যায়।
সব লেখা যেন তার নিজের ভাষায়, নিজের চিন্তায়।
কিন্তু নামটা অন্য।
ডায়েরির শেষ পাতায় লেখা:
আমি গেলাম। ইলার মুক্তি হোক। কিন্তু যদি আমার ফিরে আসার দিন আসে, আমি চাই, কেউ আমায় মনে করুক…
যদি দরজা না বন্ধ হয়, তাহলে প্রেম শুধু বন্ধন, মুক্তি নয়।”
রাফিদ বুঝতে পারে, সে শুধু নতুন একজন শিক্ষক নয়।
সে নিজেই একটা চক্রের উত্তরসূরি।
একদিন গভীর রাতে, কুয়াশায় ঢাকা সেই মঞ্জিলের দিকে হাঁটতে হাঁটতে সে চলে আসে দরজার সামনে।
এবার দরজাটা খোলা। আগেরবারের মতো নয়—এবার স্বাগত জানিয়ে খোলা।
একটা কণ্ঠস্বর ভেসে আসে—
“তুই যদি চাস এই চক্র ভাঙতে… তবে তোর নিজের আত্মা ফিরিয়ে নিতে হবে।”
হঠাৎ সে দেখতে পায় দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে আছে ইলা নয়, মানাফ।
তার চোখে ক্লান্তি, কিন্তু শান্তি।
“তুই যদি নিজেকে চিনতে পারিস, তবেই এই বন্ধন শেষ হবে। নয়তো আবার ২৫ বছর… ৫০ বছর…”
🔥 চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত
রাফিদ এবার আর ভয় পায় না।
সে চোখ বন্ধ করে মনে করে সেই ডায়েরির শেষ শব্দ—
> “আমি তোর…”
সে বলে, “আমি রাফিদ না… আমি মানাফ। আমি নিজেকে ফিরিয়ে নিতে এসেছি। আমি প্রেমের জন্য দিয়েছিলাম, এবার মুক্তির জন্য চাইছি।”
তখন দরজার মধ্য থেকে ইলার ছায়া এসে বলে—
“তুমি পারবে তো? আত্মাকে ফিরিয়ে নিতে হলে প্রেম ভুলতে হয়…”
রাফিদ চুপ করে থাকে।
তারপর সে ধীরে দরজার দিকে হাত বাড়ায়…
দরজার রঙ বদলে যেতে থাকে—গাঢ় নীল থেকে ধূসর, তারপর ধূসর থেকে সাদা।
একটা বজ্র শব্দ হয়, মাটিতে ফাটল ধরে।
আর তারপর… সব নিঃশব্দ।
নতুন সকাল
পরদিন ভোরে গ্রামের মানুষ দেখে—সায়রা মঞ্জিল ভেঙে পড়ে গেছে।
কেউ বলে ভূমিকম্প হয়েছিল।
কেউ বলে আকাশ ফেটেছিল।
কিন্তু রাফিদ?
সে আর নেই।
তার কক্ষে একটা মাত্র চিঠি পাওয়া যায়, যেখানে লেখা—
চক্র ভাঙা গেছে। এখন দরজা শুধু দরজা। আর কেউ ডাকবে না… আর কেউ হারাবে না…
থেকে গেলো কিছু প্রশ্ন
১)রাফিদ কোথায় গেল? সে কি বেঁচে আছে অন্য কারও মধ্যে?
২)ইলার প্রেম কি নিঃস্বার্থ ছিল, নাকি সে শুধুই মুক্তির পথ হিসেবে মানাফকে ব্যবহার করেছিল?
৩)যদি কেউ সায়রা মঞ্জিল আবার নতুন করে গড়ে তোলে—তবে কি সেই নীল দরজা আবার খুলবে?
৪)রাফিদ যদি মানাফের পুনর্জন্ম হয়, তাহলে তার জন্ম কেন সেই ঠিক ২৫ বছর পরেই হলো?
৫)নীল দরজাটা কি সত্যিই বন্ধ হয়েছে, নাকি কেউ আবার একদিন ভুল করে তা খুলে ফেলবে?
সমাপ্তি........??