📖 ছায়ার পেছনে
🕯️— শেষ অধ্যায় : আলোয় ফেরা
ঘরের কাচভাঙা জানালা দিয়ে ফজরের আলো একটু একটু করে ঢুকছে।
দশ রাতের দীর্ঘ অন্ধকার যেন আজ ভোরে প্রথমবার দম ফেলেছে।
শাওন ও মায়া—দুজনেই নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে ভেঙে‑পড়া আয়নার ধ্বংসস্তূপের মাঝে।
অথচ ভেতরটা এখন আর শূন্য নয়; কেমন এক হালকা প্রশান্তি ছড়িয়ে রয়েছে, ঠিক দিনের প্রথম আলোটার মতো।
⸻
1️⃣ অজানা পায়ের শব্দ
দূর থেকে দরজার ক্লান্ত কড়া পড়ে—
ঠক… ঠক…
একটা ছায়া ঢুকে পড়ে আঁধারঘেঁষা হলরুমে।
কালো ওভারকোট, চোখময় ফক্ফকে ক্লান্তি—
রাহুল, রাকার ভাই।
রাহুল (নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসা গলায়) :
“সবটা শেষ? … নাকি এই ভোরটাও ছায়া?”
মায়া এগিয়ে এসে কাঁপা গলায় বলল—
“তুমি এখানে কেন, রাহুল? এতদিন পর?”
⸻
2️⃣ শেষ পাপের স্বীকারোক্তি
রাহুল হাতে ধরা একটা সিকিউরিটি‑ড্রাইভ মেঝেতে রাখল।
মনিটরে ফুটে উঠল সেই রাতের সম্পূর্ণ ফুটেজ—কোনও কাটাছেঁড়া নেই।
সত্য দেখা গেল—
• রাকা সত্যিই নিজে ঝাঁপ দিয়েছিল, কিন্তু
• তার থামানোর মতো কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল শাওনের ‘ছায়া’—মানে শাওনের অনিয়ন্ত্রিত মানসিক ভাঙন।
• আর রাহুল? সে–ই ছিল পর্দার পেছনের কুশীলব, যে শোককে প্রতিশোধে বদলে শাওনের ভেতরকার অপরাধবোধকে চরমে তুলতে চেয়েছিল—ছায়াকে শক্তি জুগিয়ে, মায়ার মনেও সন্দেহের বীজ বুনে দিয়ে।
রাহুল (চোখ জ্বালা ধরে রাখা গলায়) :
“আমি ভাবতাম, শাওনের শাস্তি হবে নিজের ভেতরের ছায়া দিয়ে ধ্বংস হওয়া।
কিন্তু—
আমি ভুলে গিয়েছিলাম, বেঁচে গেলে ওকে দিয়েই রাকার ভালোবাসার শেষ অধ্যায় লেখা হবে।”
রাহুল হাঁটু গেড়ে বসে।
কাঁধ ঝাঁপসা, চোখ ভিজে, ঠোঁট ফাঁটে—
“ক্ষমা করে দাও… আমি আলো ভুলে ছায়া হয়েছিলাম।”
⸻
3️⃣ ছায়া থেকে সূর্যোদয়
শাওন মৌন চোখে সামনে হাঁটু গেড়ে থাকা মানুষটাকে দেখল।
তারপর ধীরে রাহুলের কাঁধে হাত রাখল।
শাওন (শান্ত, ভাঙ্গা গলায়) :
“রাকা যেদিন ছায়া হলো, আমিও ছিলাম আরেকটা ছায়া।
ওর না‑থাকা, তোমার প্রতিহিংসা, আমার অপরাধবোধ—সবই একসঙ্গে আমাদের গিলে ফেলেছিল।
আজ আলোয় দাঁড়াচ্ছি… দেরি হলেও।”
মায়া এগিয়ে এসে দুই ছেলেভাইয়ের মাঝে দাঁড়াল।
তার কণ্ঠে অনুরণিত হল অনির্বাণ শক্ত এক স্নিগ্ধতা—
মায়া :
“ভালোবাসা ভুল করলে শাস্তি দেয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে‑ই তো বাঁচায়।
আমরা যদি সত্যি চাই, রাকার গল্পটাকে শেষ করতে পারি আলোয়—কেউ আর ছায়া হবে না।”
⸻
4️⃣ রাকার শেষ চিঠি
রাহুল কোটের ভেতর থেকে একটা হলুদপাড়া চিঠি বের করল—রাকার হাতে লেখা, মৃত্যুর আগের দিন ডাকে পাঠানো, কিন্তু রাহুল খুলে পড়েনি এতদিন।
মায়া পড়ে শোনাল—
“প্রিয় রাহুল,
যদি কাল আমার ছায়া না ফেরে, জানবে আমি মুক্তি পেয়েছি।
শাওনের ভেতর বড় একটা অন্ধকার আছে—ওর অপরাধ নয়, ওর অসুখ।
ওকে আগলে রেখো, আর আমার মায়াকে বলো—আমি ছায়া নই, আলোয় একদিন ফিরব।”
সবাই স্তব্ধ।
সুন্দর এক নীরবতায় জানান দেয়—রাকার আত্মা আজ স্বস্তি পেয়েছে।
⸻
5️⃣ বন্ধ দরজা, খুলে যাওয়া পথ
দরজার বাইরেটা আগের মতো ভয়াবহ বাড়ি নয়—
সূর্য উঁকি দিয়েছে, পাখির শব্দ শোনা যায়।
মায়া শওনের হাত ধরল; রাহুল একটু দূরেই দাঁড়িয়ে।
তিনজন একসঙ্গে বেরিয়ে এল সেই বাড়ি থেকে—
পেছনে পড়ে রইল গুমোর ধুলো, ভাঙা আয়না আর রক্তমাখা ছায়ার কুসুম্ব।
একটা পায়ে‑চলা মেঠোপথ—সামনে সদ্য ভেজা আলো।
শাওন পেছন ফিরে শেষবারের মতো তাকাল।
বাড়ির ছায়া লম্বা হয়ে মাটিতে পড়ছে, কিন্তু আলোয় ভিজে একসময় মুছে গেল।
⸻
6️⃣ উপসংহার — আলোর চিঠি
কিছুদিন পরে—
শাওন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাহায্যে নিজের ট্রমা আর “দ্বৈত সত্তা” সামলাতে শুরু করে।
মায়া তার পাশে—প্রেম না বলা, তবে উপস্থিত, দৃঢ়।
রাহুল পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে যতটুকু তার অপরাধ; আইন মাফিক সে মুক্তি পাবে, কিন্তু তার সাক্ষ্যেই রাকার ঘটনাটা অফিসিয়ালি আত্মহত্যা‑সদৃশ মানসিক দুর্ঘটনা হিসেবে খতিয়ান পেল।
রাকা নেই, তবু তার চিঠির শেষ লাইন তিনজনকেই বাঁচিয়ে দিল—
“ছায়া থেমে যাবে, যদি আলোকে গ্রাহ্য করো।”
⸻
🌅 সমাপ্তি
রাতের দীর্ঘ ছায়া শেষ হলে,
ভোরের আলো শুধু প্রতিফলন নয়—
সেটা নতুন গল্পের আরম্ভ।