Posts

প্রবন্ধ

ইসরায়েল ও ইরান দ্বন্দের ভবিষ্যৎ

June 15, 2025

M. Khanam

103
View
ছবিসূত্র: দ্যা ডেইলি ইত্তেফাক

ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যকার দ্বন্দ শুধু এই দুটি দেশ বা মধ্যপ্রাচ্যের নয় বরং প্রভাব ফেলছে বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতিতেও, সারা বিশ্বের জন্যই এটি হয়ে দাড়াচ্ছে মহাসংকট। আজকের আমরা জানবো কীভাবে শুরু হলো এই সংঘাত, এর বর্তমান পরিস্থিতি, এবং এর ভয়ঙ্কর ছায়া কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে। 

ইতিহাস: দ্বন্দ্বের সূচনা

ইরান–ইসরায়েল দ্বন্দ্বের মূল সূচনা ঘটে ১৯৭৯ সালে, যখন ইরানে ইসলামী বিপ্লব ঘটে। এই বিপ্লবের মূল কারণ ছিল ইরানের শেষ রাজা মোহাম্মদ রেজা পাহলভীর পশ্চিমা বা বিশেষত মার্কিন আমেরিকাপন্থী দমননীতি, রাজপরিবারের দুর্নীতি ও এর কারনে জনগনের ভেতর তৈরি হওয়া ধর্মীয় ও জাতীয়তাবাদী ক্ষোভ। ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমেই ইরানের রাজতন্ত্র বিলুপ্ত হয় এবং প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলামী প্রজাতন্ত্র যা ইসরায়েলকে রাষ্ট্র হিসেবে অস্বীকৃতি জানায়। তারা ইসরায়েলবিরোধী গোষ্ঠীগুলো (যেমন, হিজবুল্লাহ, হামাস)-কে সমর্থন দিতে শুরু করে। এবং ইরানে অবস্থিত মার্কিন ও ইসরায়েলি দূতাবাস বন্ধ করে দেয়।

এরপর থেকেই এই দ্বন্দ্ব রূপ নেয় ‘প্রক্সি যুদ্ধ’–এর। প্রক্সি যুদ্ধ হলো এমন এক ধরনের যুদ্ধ যেখানে দুই বা ততোধিক বড় শক্তি সরাসরি যুদ্ধ না করেই, অন্য দেশ বা গোষ্ঠীর মাধ্যমে তাদের স্বার্থে লড়াই করে। ইরান হিজবুল্লাহ, হামাস ও সিরিয়ার মিলিশিয়াদের মাধ্যমে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রক্সি হামলা চালায়, এবং ইসরায়েল সিরিয়ায় ইরানি ঘাঁটি ও এসব গোষ্ঠীর অস্ত্রভাণ্ডারে হামলা চালিয়ে ইরানের প্রভাব কমাতে চায়। 

২০০০-এর দশক থেকে শুরু হয় একের পর এক গোপন হামলা, সাইবার অ্যাটাক, বিজ্ঞানীদের হত্যা, এবং শেষমেশ ২০২৪–২৫ সালে এই দ্বন্দ রূপ নেয় সরাসরি আকাশপথে ক্ষেপণাস্ত্র হামলায়।

ইসরায়েলের হামলা ও এর কারন

২০২৫ সালের ১৩ জুন ভোরবেলা, ইসরায়েল “Operation Rising Lion” নামে একটি ব্যাপক পরিকল্পিত প্রি-এম্পটিভ আক্রমণ চালায় ইরানের উপর। প্রি-এম্পটিভ আক্রমণ হল প্রতিপক্ষ হামলা চালাবে বলে বিশ্বাসযোগ্য আশঙ্কা থাকলে, সেই আশঙ্কাকে প্রতিহত করা জন্য প্রথমে আক্রমণ চালানো। 

এই অভিযানে ইসরায়েলি বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে ছয় স্তরের সমন্বয়ে একাধিক লক্ষ্যবস্তুতে স্ট্রাইক চালানো হয়। মূল লক্ষ্য ছিল ইরানের পারমাণবিক ও সামরিক অবকাঠামো—বিশেষ করে নাতানজ, ফোর্ডো, তেহরান, ইসফাহান, তাবরিজ, কেরমানশাহ এবং হামাদান সহ প্রায় ১০০টিরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ স্ট্রাকচার।

ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সহায়তায় ড্রোনের মাধ্যমে গোপন অভিযান চালিয়ে ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং ক্ষেপণাস্ত্র ভাণ্ডারেও বড় ধরনের ক্ষতি করা হয়। এই হামলায় ইরানে প্রায় ৭৮ থেকে ১০০ জন নিহত হয়, যার মধ্যে হোসেইন সালামি, মোহাম্মদ বাঘেরি, আমির আলী হাজিজাদেহ এবং গোলাম আলী রাশিদসহ অন্তত ২০ জন শীর্ষ সামরিক কমান্ডারও ছিলেন। এছাড়াও ৬ থেকে ৮ জন পারমাণবিক বিজ্ঞানী, যাদের মধ্যে ফেরেইদুন আব্বাসি-দাভানি এবং মোহাম্মদ মেহদি তেহরানচি অন্যতম, হামলায় নিহত হন। আহতের সংখ্যা প্রায় ৩২০ জনেরও বেশি। 

ইরানের পালটা হামলা

১৩ জুন সন্ধ্যায় ইসরায়েলের “Operation Rising Lion”-এর পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসেবে ইরান “Operation True Promise III” নামে একটি বৃহৎ আক্রমণ শুরু করে, যা গভীর রাত পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এই অভিযানে ১৫০টিরও বেশি ব্যালিস্টিক মিসাইল এবং ১০০টির বেশি ড্রোন ব্যবহার করা হয় যার মূল লক্ষ্য ছিল ইসরায়েলের রাজধানী তেল আবিব, জেরুজালেম, বেন গুরিয়ন বিমানবন্দর, হাইফা, কিরিয়াত (আইডিএফ বা ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী সদর দপ্তর), এবং আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ শহর। এটিকে মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসের অন্যতম বড় একক সামরিক আক্রমণ বলা হচ্ছে। 

এই হামলায় ইসরায়েলে ১৪ জন নিহত হয় এবং ২০০-র বেশি মানুষ আহত হয়েছে বলে জানা যায়। এছাড়াও বেশ কয়েকটি আবাসিক ভবন ধ্বংস হয়ে যায় যার কারনে প্রায় ৭০০-এর বেশি মানুষ তাদের ঘরবাড়ি হারায়। 

এত ব্যাপক হামলার পরও এই সীমিত ক্ষতির অন্যতম কারন হল ইসরায়েলের অত্যাধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, বিশেষ করে Iron Dome ও David’s Sling যা ইরানের অধিকাংশ মিসাইল সফলভাবে ধ্বংস করে। এছাড়া এই সময় যুক্তরাষ্ট্রও দ্রুত ইসরায়েলকে উন্নত প্রযুক্তির রাডার সিস্টেম, ক্ষেপণাস্ত্র শনাক্তকরণ ডেটা শেয়ার এবং দ্রুত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সক্রিয় করার জন্য স্যাটেলাইট থেকে রিয়েলটাইম গোয়েন্দা তথ্য প্রদান করে এই ক্ষতি কমাতে সাহায্য করে।

আন্তর্জাতিক মহলের প্রতিক্রিয়া

ইরানের পালটা আক্রমণের ১২ ঘণ্টার মধ্যেই UN Security Council একটি জরুরি বৈঠক ডাকে। বৈঠকে রাশিয়া, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ফ্রান্সসহ সদস্য রাষ্ট্ররা উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষার আহ্বান জানায়। 

এই বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্টভাবে ইসরায়েলের পক্ষে অবস্থান নেয়। তারা বলে, ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় পড়ে এবং তা যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করে। এবং হুঁশিয়ারি দিয়ে জানানো হয়, ভবিষ্যতে ইরান যদি আরও কোনো আক্রমণ চালায়, তাহলে তার বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিক্রিয়া যুক্তরাষ্ট্র জানাবে। 

অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ইরানের প্রতি “কঠোর প্রতিক্রিয়া”–সংকেতের জবাবে, চীন শক্তিশালী বিরোধ পেশ করছে—ইসরায়েলের সামরিক পদক্ষেপকে ইউএন সম্মেলনে অবৈধ আক্রমণ হিসেবে চিহ্নিত করে “বাতিল ও অবিলম্বে বন্ধ” করার দাবি তুলছে, এবং একই সঙ্গে নিরাপত্তা-সতর্কতা বাড়াচ্ছে। 

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, “মধ্যপ্রাচ্য এখন এক বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। এই সংঘর্ষ অবিলম্বে বন্ধ হওয়া উচিত…এখন সময় এসেছে উত্তেজনা কমিয়ে শান্তি ও কূটনীতির মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের।”


 

ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব বর্তমানে একটি আঞ্চলিক সমস্যার চেয়ে বিশ্ব অর্থনীতি, কূটনীতি, এবং নিরাপত্তা স্থিতিশীলতার হুমকিতে পরিণত হয়েছে। দ্বন্দ্ব যদি দীর্ঘস্থায়ী হয় বা তৃতীয় পক্ষ (যেমন যুক্তরাষ্ট্র বা চীন) এর সম্পৃক্ততা বাড়ে, তাহলে এর ফলাফল হবে ভয়ংকর। এখন দরকার দায়িত্বশীল কূটনীতির, যেখানে যুদ্ধ নয়, শান্তির মাধ্যমে একটি স্থায়ী সমাধানের পথ খুঁজে বের করা হবে।

Comments

    Please login to post comment. Login