বৃষ্টির দিন ছিল সেদিন। জানালার ধারে বসে নীলা ছাদের টিনে বৃষ্টির শব্দ শুনছিল। প্রতিটি ফোঁটা যেন তার মনের ভেতর জমে থাকা কান্নার সুর বাজাচ্ছিল। আজ ঠিক তিন বছর হয়ে গেলো অরণ্য চলে গেছে — না, মারা যায়নি… চলে গেছে নীরবে, একটাও কথা না বলে, একটাও অভিযোগ না রেখে।
নীলা প্রতিদিন একটা কাজ করতো — সে একটা চিঠি লিখত অরণ্যকে। কিন্তু কখনো পাঠায়নি। জমিয়ে রেখেছে ড্রয়ারের এক কোনায়। শত শত চিঠি, অরণ্যের উদ্দেশে… কিন্তু সবই ছিল নীরব। ঠিক যেমনটা অরণ্য চলে গিয়েছিল।
অরণ্য ছিল এক অন্যরকম মানুষ। খুব বেশি কথা বলত না, কিন্তু চোখে ছিল অদ্ভুত এক গভীরতা। তারা একসাথে ক্লাস ফোর থেকে ক্লাস টুয়েলভ পর্যন্ত পড়েছে। কখন যে বন্ধুত্বটা ভালোবাসায় রূপ নিয়েছে, তা কেউই জানত না। নীলার ডায়েরির পাতায় প্রতিদিন অরণ্যের নাম লেখা থাকত, কিন্তু অরণ্য বলত না কিছুই। শুধু একবার বলেছিল, "যদি কোনোদিন হারিয়ে যাই, জানবে আমি তোর কাছেই আছি, ঠিক তোর মনখারাপের মুহূর্তে..."
একটা দুর্ঘটনা সবকিছু পাল্টে দিলো। অরণ্যের বাবা-মা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলেন, আর অরণ্য আত্মীয়ের বাড়িতে চলে গেলো দেশের অন্য প্রান্তে। সে এমনভাবে চলে গেলো, যেন তার অস্তিত্ব শুধু নীলার স্মৃতিতে আটকে থাকল।
তিন বছরের মধ্যে অরণ্য কোনো যোগাযোগ করেনি। নীলা একবার চেয়েছিল ফোন করতে, কিন্তু সাহস পায়নি। ভেবেছিল, অরণ্য যদি চাইত, ঠিক ফিরে আসত। তবুও সে অপেক্ষা করত। রোজ একটা করে চিঠি লিখত। অনেকগুলো চিঠি জমে গেছে — সবগুলোতে শুধুই অরণ্যকে নিয়ে স্মৃতি, অভিমান, ভালোবাসা আর অপেক্ষার কথা।
আজকের চিঠিতে লিখল:
“তুই জানিস, আমি এখনো তোর জন্য অপেক্ষা করি? লোকজন ভাবে আমি পাগল। কিন্তু তোর ছেড়ে যাওয়া ওই শেষ চাহনিটা — সেটা এখনো আমার ঘুম কেড়ে নেয়। তুই যদি ফিরে আসিস… কিছু না বললেও চলবে। শুধু বসে থাকিস আমার পাশে, নীরবে। কারণ, এই নীরবতাই তো ছিল আমাদের ভাষা।”
চিঠিটা শেষ করে ড্রয়ার খুলে রাখলো নীলা। আজকের রাতে হঠাৎ করেই অরণ্যের একটা পুরোনো ছবি হাতে এলো তার। ছবি খুলতেই পিছনে লেখা:
“যদি একদিন চলে যাই, মনে করিস নীরবির চিঠি লিখে যাচ্ছি তোর জন্য। নীলার জন্য।”
নীলার চোখে জল চলে এলো, কিন্তু মুখে এক চিলতে হাসি ফুটল — কারণ এই প্রথমবার, সে বুঝলো অরণ্যও তাকে ভালোবাসত… নীরবে, শব্দহীন ভাষায়।
তবে সেদিন রাতে যা ঘটল, তা ছিল এক অলৌকিক মুহূর্ত। দরজার নিচ দিয়ে একটা খাম ঢুকল ঘরের ভিতরে। অবাক হয়ে খুলে দেখে — অরণ্যের হাতের লেখা। ঠিক সেই পুরনো অক্ষর, যেখানে প্রতিটি বর্ণে নীলার নাম লুকানো থাকত। খামে লেখা:
"আমি ফিরছি, কিন্তু এইবার শব্দ নিয়ে নয় — চিরদিনের জন্য নীরবির চিঠি হয়ে।"
নীলা জানত না সে স্বপ্ন দেখছে, না বাস্তব। কিন্তু তার চোখে জল আর মনে প্রশান্তি — যেন সমস্ত চিঠির উত্তর পেয়ে গেছে সে, একটিমাত্র চিঠিতে।
77
View