শিমুলপুর গ্রামটা খুব চেনা। একপাশে তাল গাছের সারি, অন্যপাশে ধানের মাঠ। গ্রামের একদম শেষ মাথায়, যেখানে কাঁচারাস্তা মিশে যায় জঙ্গলের মতো গাছগাছালিতে, সেখানেই একটা পুরোনো, ভাঙাচোরা বাড়ি। সেই বাড়িতেই থাকতেন একরম কাকু।
অনেকের কাছে তিনি ছিলেন রহস্য।
অনেকে বলত, তিনি নাকি উন্মাদ।
কেউ বলত, জাদু জানেন।
আবার কেউ বলত, উনি আসলে একা নন — ওনার সাথে কেউ থাকে, যাকে কেউ দেখতে পায় না।
এইসব শুনে গ্রামের ছেলেমেয়েরা দূর থেকে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে হাসাহাসি করত। কিন্তু কেউ কখনও সাহস করে খুব কাছে যেত না।
আমি, আরিফ, তখন নবম শ্রেণিতে পড়ি। বইপড়া, গল্প লেখা, এসব আমার খুব পছন্দ — কিন্তু মনের মধ্যে এক ধরনের কৌতূহল সবসময়ই কাজ করত। মানুষ কেন পাল্টে যায়? কিছু কিছু মানুষ কেন নিঃশব্দে বাঁচে?
একরম কাকুকে দেখার আগ্রহ আমার সেই থেকেই।
প্রতিদিন দুপুরে আমি দেখতাম — উনি বারান্দার এক কোণে বসে থাকেন।
সামনে রাখা একটা পুরোনো, বড় আয়না। ধুলো জমা কাচ, ফ্রেমে ফাটল, কোথাও কোথাও মরিচা পড়ে গেছে।
কিন্তু উনি সেই আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকতেন অবিচলভাবে। যেন অপেক্ষা করছেন কিছু একটা দেখার জন্য।
একদিন সাহস করে জিজ্ঞেস করলাম,
— “কাকু, আপনি এভাবে কী দেখেন আয়নায়?”
একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে উনি বললেন,
— “সব আয়না চোখের সামনে যা দেখায়, তা নয়। কিছু আয়না মানুষ যা হারিয়েছে, তা ফিরিয়ে দেয়।”
আমি থেমে গেলাম। তখনো বুঝিনি উনি ঠিক কী বলতে চাইছেন।
তারপর একটা ঘটনা ঘটল।
একদিন বিকেলে হঠাৎ একটা চিৎকার শুনে ছুটে গেলাম কাকুর বাড়ির সামনে। দরজা খোলা। ভিতরে গিয়ে দেখি, কাকু পড়ে আছেন, নিস্তেজ, আয়নার সামনে। আর সামনে রাখা একটা ছোট চিঠি। হাতে লেখা, কাঁপা অক্ষরে:
“সে ফিরেছে। এবার আমাকে নিয়ে যাবে।”
সেইদিন থেকেই কাকু নেই। কেউ জানে না উনি মারা গেছেন, নাকি কোথাও চলে গেছেন।
গ্রামের লোক বলল — "শয়তান নিয়েছে", কেউ বলল — “মেয়ে ফিরেছে, নিয়েছে ওকে।”
কিন্তু তারপর যা ঘটল, সেটা আমি কাউকে বলতে পারিনি, এখনও বলিনি।
এক রাতে, ঠিক কাকুর পুরোনো বাড়িটার সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখি — জানালার ফাঁক দিয়ে আলো।
আলো না বলে বলা ভালো, ঝাপসা একটা নীলচে আভা।
আমি সাহস করে বারান্দার দিকে তাকালাম —
পুরোনো সেই আয়নার কাচে কার ছায়া।
একটা মেয়ের ছায়া।
সে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।
আর ঠিক সেই আয়নার কোণায় বসে আছেন কাকু। এবার আর ধুসর নয় — ওনার মুখে প্রশান্তি, চোখে জল। মেয়েটি মাথা হেলিয়ে তাঁর কাঁধে হাত রেখেছে।
আমি দম আটকে তাকিয়ে থাকি…
তারপর আচমকা সব নিঃশব্দ, নিভে যায়।
পরদিন সকালে আবার সেই আয়না, সেই জায়গা — সব আগের মতো। শুধু এক জায়গায় একটা দাগ — যেন কারো হাতের ছাপ পড়ে আছে কাচের উপর।
শেষ কথা
এই গল্পটা আমি কাউকে বলিনি।
কারণ কেউ বিশ্বাস করবে না।
কিন্তু আমি জানি — কিছু সম্পর্ক, কিছু অভিমান, কিছু ভালোবাসা কখনও মরে না। তারা ছায়ার ভিতর বেঁচে থাকে, অপেক্ষা করে।
আর হয়তো কোনো একদিন — ফিরেও আসে।