Posts

উপন্যাস

তোমার জন্য....(পর্ব -৫৫)

June 16, 2025

Boros Marika

75
View

মিস্টার আমান জানালার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা তৃষার দিকে তাকিয়ে থেকেও যেন চোখ ফিরিয়ে নিতে চাইছিলেন। তবু পারছিলেন না। ভিতরে ভিতরে বুকের ভেতর একটা অদৃশ্য দহন চলছিল। মনে মনে ভাবছিলেন—

"প্রথম যেদিন তোমাকে দেখেছিলাম, মনে হয়েছিল—তোমার চোখের গভীরে কোনো এক সমুদ্র লুকিয়ে আছে। সেই সমুদ্রের ঢেউ আমায় ডাকছে। তখন কল্পনাও করিনি, একদিন তুমি আমার পাশে থাকবে… এইভাবে… অথচ… তোমার থাকার কথা তো ছিল অন্য কারও পাশে—আরিয়ান এর পাশে।"

ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠছিল। এই প্রাপ্তি যেন এক অসম্পূর্ণতার বোঝা।

"তুমি আমার পাশে, কিন্তু মনটা কি আমার? নাকি ও এখনো পড়ে আছে আরিয়ানের মনে করা কোনো কথার দিকে? কোনো অনিচ্ছাকৃত ছোঁয়ার দিকে? আমি কি শুধু একটা নিরাপদ ঠিকানা, না কি সত্যিই তোমার জীবনের পরের অধ্যায়?"

মিস্টার আমান এর গলার কাছটা শুকিয়ে আসছিল, বুকটা ভারী লাগছিল। তৃষা তখনও জানালার বাইরে তাকিয়ে, কিছু বোঝে না এমন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিল, অথচ তার অসংলগ্ন নীরবতা যেন কথা বলছিল—একটা অজানা লজ্জা, একটা অস্বস্তি, কিংবা কোনো না বলা বেদনার ভাষায়।

মিস্টার আমান চোখ বন্ধ করে এক মুহূর্ত ভাবলেন—

"আমি চাইনি এভাবে তুমি আমার হও। আমি তো চেয়েছিলাম তুমি নিজে থেকে আসো… ভালোবেসে, মন উজাড় করে…"

তার দৃষ্টি তৃষার পায়ের দিকে নামছিল, আবার চোখে এসে আটকে যাচ্ছিল সেই চোখে, যা এখনো ঘন নীল রাতের মতো রহস্যময়।

মিস্টার আমান নিজেকে যতটা সম্ভব গুছিয়ে নিয়ে বললেন, গলা একটু কাঁপছিল, তবু চেষ্টায় ছিলেন স্থির থাকার—

"তৃষা… একটু শুনুন…"

তৃষা ধীরে ধীরে জানালার দিক থেকে ফিরে এলো। ওর চোখে এক ধরনের দ্বিধা, ঠোঁটের কোণে এক চিলতে লজ্জা, এবং চলাফেরায় একটা স্নিগ্ধ সংযম। মিস্টার আমান ওকে দেখে আবার একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। কিন্তু নিজেকে দ্রুতই সামলে বললেন—

"এই রুমে… যতদিন আমরা একসাথে থাকি, ততদিন এই ঘরটা শুধু আমার না, আপনারও। তাই এখানে যা কিছু আছে—এই বিছানা, এই আলমারি, এই আয়না—সব কিছুই আমাদের দুজনের। আপনি আপনার সব কাপড়, অন্যান্য জিনিসপত্র সাজিয়ে রাখুন… তাহলে আমার ভালো লাগবে।"

তৃষা কিছু না বলে এক মুহূর্ত ওর দিকে তাকিয়ে থাকল। এরপর চোখ নামিয়ে শান্তভাবে মাথা নাড়ল সম্মতির ভঙ্গিতে। ছোট্ট একটা হাসিও যেন ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠেছিল, যদিও খুব মৃদু।

এই নীরব সম্মতিতে যেন ঘরের বাতাসটা একটু আলাদা হয়ে গেল। একটা অদৃশ্য জড়তা ভাঙল, কিছুটা স্বস্তি, কিছুটা আলগা আন্তরিকতা ছড়িয়ে পড়ল সেই ছোট্ট রুমজুড়ে।

তৃষা ধীরে পা ফেলতে ফেলতে দাদির রুমের সামনে এসে দাঁড়াল। দরজার কাছে এসে হালকা কাশির মতো করে একটা শব্দ করে নক করল। ভিতর থেকে শান্ত, কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে দাদি বললেন—

"ঢুকো, তৃষা।"

তৃষা দরজাটা ধীরে খুলে ভিতরে ঢুকল। দাদির রুমটা যেমন ছিল, ঠিক তেমনই—সব কিছু পরিপাটি, পুরনো দিনের গন্ধে মোড়া, দেয়ালে কিছু সাদাকালো ছবি, মাথার পাশে পবিত্র কোরআন শরিফ খোলা আছে। দাদি চশমা পরা চোখে তৃষার দিকে তাকালেন, যেন অনেক কিছু বুঝে ফেলেছেন।

"এসো বসো, একটু কথা আছে তোমার সাথে।" দাদি বললেন বিছানার পাশে রাখা কাঠের চেয়ারের দিকে ইশারা করে।

তৃষা চুপচাপ মাথা নিচু করে এসে বসল। দাদির সামনে বসা মাত্রই যেন আবার একটা অদৃশ্য দায়িত্বের ভার এসে পড়ে ওর কাঁধে।

"তুমি এখন এই বাড়ির ইজ্জত, বউ হয়ে এসেছো, এই সম্পর্ক কাগজে-কলমে হোক বা বাস্তবে, সমাজ দেখবে তোমার দিকে।"
"আমি জানি, অনেক কিছু তোমার নিজের মতো হয়নি। কিন্তু তবুও এই বাড়িতে তোমার একটা বড় দায়িত্ব আছে। তুমি পারবে তো সেটা পালন করতে?"

তৃষা কিছু বলল না, শুধু চোখ তুলে দাদির চোখে তাকাল। দাদির দৃষ্টি নরম হলেও সেই চাহনিতে দৃঢ়তা ছিল—ভালোবাসা আর বাস্তবতার এক মিশ্র প্রকাশ।

দাদি ধীরে ধীরে পাশের কাঠের আলমারিটা খুললেন। ভিতর থেকে সোনালী রঙের মখমলের বাক্সটা তুলে আনলেন—যেটার গায়ে ঘন জরির কাজ আর প্রাচীন রাজকীয় এক ধরণের গাম্ভীর্য। তৃষা নিঃশব্দে তাকিয়ে ছিল।
দাদি গহনার বাক্স খুলে যখন সেটটা তুলে ধরলেন, তখন ঘরের আলোতে চোখ ধাঁধানো এক সবুজ আলো ছড়িয়ে পড়ল। হীরের মাঝে বসানো পান্না পাথরের নিখুঁত ঝলক—একটা একরকম রাজকীয় সবুজ, যেটা তৃষার গায়ের উজ্জ্বল গমের বর্ণের সঙ্গে অপূর্বভাবে মিশে যায়।

দাদি মৃদু হেসে বললেন—

“এই সেটটা কিন্তু একটু আলাদা। পান্না আর হীরের কম্বিনেশন আমি নিজে ডিজাইন করেছিলাম। এইসব পুরনো দিনে এসব খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কালকের অনুষ্ঠানে এইটা পরলে কারো চোখ থাকবে না তোমার ওপর থেকে।”

তৃষা একটু চমকে বলল,
“এত দামী গয়না… আমি কি মানাতে পারব?”

দাদি একটু অভিমানী ভঙ্গিতে বললেন—
“তুমি মানাবে না? তুমি তো আমাদের বাড়ির গর্ব, মা। এত কম বয়সে এত ধৈর্য আর সম্মান নিয়ে এ বাড়িতে এসেছো—আমি জানি, তুমি কাল রাণীর মতো দেখাবে।”

তারপরই দাদি পাশের আলমারি খুলে আরেকটা বাক্স নামালেন। সেটা খুলে বের করলেন এক অপূর্ব সবুজ-রুপোলি রঙের কাঁথি শাড়ি—জরির কাজটা এত সূক্ষ্ম যে মনে হয় যেন পাতার ওপর শিশিরের ফোঁটা বসানো।

দাদি বললেন—
“এই শাড়িটাও আমি এনেছিলাম সেই সময়ে, কিন্তু পরে পরার সুযোগ হয়নি। সেটার রং আর এই গহনাটার রং একদম মিলে গেছে। তুমি এই শাড়িটা পরবে। খাঁটি বেনারসি—এমন শাড়ি এখন আর বানায় না কেউ।”

তৃষা চোখে জল চেপে মৃদু হাসল, মাথা নোয়াল—
“আচ্ছা দাদি, কাল আমি আপনার ইচ্ছামতো সাজব।”

দাদি হাসতে হাসতে বললেন—
“সাজবে না, ঝলকে উঠবে।”

এই মুহূর্তে মিস্টার আমান দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে সব শুনছিলো—তৃষার হাসি, দাদির ভালোবাসা, আর তার নিজের ভিতরের টানাপোড়েন।

চলবে......
 


 

Comments

    Please login to post comment. Login