🕋 শিয়া-সুন্নি পার্থক্যের কুরআনিক ও হাদীস ভিত্তি
🔹 ভূমিকা:
শিয়া ও সুন্নির মধ্যে মূল পার্থক্য ইমামত বা নেতৃত্ব সংক্রান্ত, যা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ওফাতের পর কে নেতৃত্ব দেবে—এই প্রশ্ন ঘিরে। উভয় পক্ষই তাদের মতকে কুরআন ও হাদীস দ্বারা সমর্থন করার চেষ্টা করেছে। তবে এই দলিলগুলোর ব্যাখ্যা ও গুরুত্ব নির্ভর করে বিশ্বাস ও ইতিহাসগত দৃষ্টিভঙ্গির ওপর।
📖 ১. কুরআন ভিত্তিক পার্থক্য:
✦ শিয়াদের প্রিয় কুরআনিক দলিলসমূহ:
(১) সূরা মায়েদা ৫:৫৫
"তোমাদের ওলী (নেতা) তো কেবলমাত্র আল্লাহ, তাঁর রাসুল এবং তারা, যারা নামাজ কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং রুকু অবস্থায় থাকে।"
শিয়ারা বলেন: এই আয়াত ইমাম আলী (আ.)-এর জন্য অবতীর্ণ, কারণ তিনি রুকু অবস্থায় আঙুলের আংটি দিয়ে যাকাত দিয়েছিলেন।
(২) সূরা শূরা ৪২:২৩
"বল, আমি তোমাদের কাছে এর (পয়গম্বরিত্ব) জন্য কোনো পারিশ্রমিক চাই না, শুধু আত্মীয়দের প্রতি মহব্বত ছাড়া।"
শিয়ারা বলেন: ‘আত্মীয়’ মানে আহলে বাইত — আলী, ফাতিমা, হাসান, হুসাইন। তাদের ভালোবাসা ঈমানের শর্ত।
(৩) সূরা আহযাব ৩৩:৩৩ (আয়াতুত তাহারাহ)
"নিশ্চয়ই আল্লাহ চান, হে আহলে বাইত, তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদের সম্পূর্ণরূপে পবিত্র রাখতে।"
শিয়ারা বলেন: ইহা প্রমাণ করে আহলে বাইত (শুধু আলী, ফাতিমা, হাসান, হুসাইন) নিখুঁত ও নিষ্পাপ, সুতরাং তারাই নেতৃত্বের যোগ্য।
✦ সুন্নিদের দৃষ্টিকোণ:
(১) সূরা আল ইমরান ৩:১৫৯
"তুমি যদি কঠোর ও কঠিন হৃদয় হতেন, তবে তারা তোমার চারপাশ থেকে সরে যেত।"
সুন্নিরা বলেন: রাসুল (সা.) সাহাবাদের সঙ্গে পরামর্শ করতেন (শুরা), নেতৃত্বও উম্মাহর পরামর্শে নির্ধারিত হওয়া উচিত।
(২) সূরা শূরা ৪২:৩৮
"...তাদের কাজকর্ম পরামর্শের ভিত্তিতে চলে।"
এই আয়াতে গণপরামর্শের ভিত্তিতে খিলাফত নির্ধারণের অনুমোদন রয়েছে বলে তারা বিশ্বাস করেন।
(৩) কুরআনে আবু বকর (রা.) বা আলী (আ.)-এর নাম স্পষ্টভাবে নেই, তাই সুন্নিরা বলেন কুরআনে ইমামত নির্ধারণ করা হয়নি, বরং হাদীস, ইজমা ও কিয়াসের মাধ্যমে বুঝতে হয়।
📜 ২. হাদীস ভিত্তিক পার্থক্য:
✦ শিয়াদের প্রিয় হাদীস:
(১) হাদীসে গাদির খুম:
"যার আমি মাওলা, তার আলী-ও মাওলা।" (من كنت مولاه فهذا علي مولاه)
বর্ণনাকারী: আহমদ ইবনে হাম্বল, তিরমিযি, নাসাঈ ইত্যাদি
শিয়া ব্যাখ্যা: "মাওলা" মানে নেতা, অভিভাবক। অর্থাৎ রাসুল (সা.) আলী (আ.)-কে নেতা নিযুক্ত করেন।
(২) হাদীসে কিসা / আহলে বাইতের হাদীস
রাসুল (সা.) ফাতিমা, আলী, হাসান ও হুসাইনকে একটি চাদরের নিচে নিয়ে বলেছিলেন: "হে আল্লাহ, এরা আমার আহলে বাইত। তাদের পবিত্র করো।"
তীরমিযি, মুসলিম, হাকেম প্রমাণ করে এই বিশেষ গোষ্ঠী শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী।
(৩) ইমাম মাহদির (আ.) হাদীস:
"আমার পর বারো জন খলিফা হবে, সবাই কুরাইশ বংশের।"
শিয়া ব্যাখ্যা: এটি ১২ ইমামের দিকে ইঙ্গিত। সর্বশেষ ইমাম মাহদি (আ.) গায়েব আছেন।
✦ সুন্নিদের প্রিয় হাদীস:
(১) রাসুল (সা.)-এর ওফাতের পর আবু বকর (রা.)-এর খিলাফত
"সবচেয়ে উত্তম ব্যক্তি আবু বকর, তারপর ওমর।"
– সহীহ বুখারী
সুন্নিরা বলেন, রাসুল (সা.) নিজেই ইঙ্গিতে আবু বকর (রা.)-কে ইমাম বানিয়েছেন (রোগের সময় সালাতে তার নেতৃত্বে মানুষকে নামাজ পড়তে বলেন)।
(২) "আমার উম্মত কখনো বিভ্রান্তির ওপর একমত হবে না"
– ইবনে মাজাহ, আবু দাউদ
অর্থাৎ উম্মাহর ইজমা (সম্মিলিত সিদ্ধান্ত), যেমন আবু বকর (রা.)-এর খিলাফত, তা সঠিক ছিল।
🧠 উপসংহার:
শিয়া ও সুন্নি উভয়েই কুরআন ও হাদীসকে দলিল হিসেবে গ্রহণ করে, কিন্তু ব্যাখ্যা ও ব্যঞ্জনা ভিন্ন।
শিয়ারা নেতৃত্বকে ইলাহি নিযুক্ত ও অপরিহার্য, আর সুন্নিরা মনে করেন উম্মাহর পরামর্শে নির্বাচিত হওয়া বৈধ।
এটি শুধুই ধর্মীয় তাত্ত্বিক প্রশ্ন নয়, বরং ইতিহাস, রাজনীতি ও সংস্কৃতির গভীর প্রভাব বহন করে।