বাংলাদেশে ইসলামি ফিকহ তথা শরিয়াহ্-ভিত্তিক জীবনচর্চায় হানাফি মাজহাবের প্রভাব ব্যাপক ও সর্বজনস্বীকৃত। প্রায় পুরো দেশজুড়ে মুসলমানরা হানাফি মাজহাব অনুসরণ করে থাকেন — ব্যক্তি ইবাদত, পারিবারিক আইন, সামাজিক আচার, এমনকি কোর্ট ও ধর্মীয় ফতোয়ার ক্ষেত্রেও।
নিচে বাংলাদেশে হানাফি মাজহাবের প্রভাবের কারণ, রূপ ও কার্যক্রম বিশ্লেষণভাবে তুলে ধরা হলো:
🕌 ১. ইতিহাস ও আগমন
🔹 ইসলাম প্রচারের সূচনা:
ইসলাম প্রথমে চট্টগ্রাম ও উপকূলীয় অঞ্চল দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করে।
১২-১৩ শতকে সুফি সাধক, ব্যবসায়ী ও মিশনারিরা বাংলায় ইসলাম প্রচার করেন।
সুলতানি ও মুঘল আমলে হানাফি মাজহাব ছিল রাজদরবার ও সমাজে প্রতিষ্ঠিত বিধানব্যবস্থা।
🔹 উপমহাদেশীয় প্রভাব:
পুরো ভারতীয় উপমহাদেশে (বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান) হানাফি মাজহাব দীর্ঘ সময় রাষ্ট্রীয় মাযহাব হিসেবে চর্চা হয়েছে।
ফতোয়া-ই-আলমগিরি (মুঘল বাদশাহ আওরঙ্গজেবের আমলে সংকলিত) হানাফি আইনকোষ ছিল, যা আদালতে ব্যবহৃত হতো।
⚖️ ২. বিচারব্যবস্থা ও আইনগত প্রভাব
🔸 মুসলিম পারিবারিক আইন:
তালাক, বিবাহ, উত্তরাধিকার, মীরাস, ভরণপোষণ ইত্যাদি বিষয় হানাফি ফিকহ অনুসারে বিচার করা হয়।
বাংলাদেশে ইসলামিক পারিবারিক আইনের যত বই, তার প্রায় সবই হানাফি মতভিত্তিক।
🔸 আদালতের রেফারেন্স:
কোর্টে ‘মুহাম্মদান ল’ বা মুসলিম পার্সোনাল ল’ হিসেবে হানাফি আইনই কার্যকর।
শরিয়া আদালত নেই, কিন্তু ফতোয়ার ভিত্তিতে অনেক সামাজিক বিরোধ মীমাংসা হয়, যেখানে হানাফি মতকে অনুসরণ করা হয়।
📘 ৩. দাওরায়ে হাদীস ও কওমি মাদ্রাসা
🔹 কওমি মাদ্রাসা:
কওমি শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত্তি দারুল উলুম দেওবন্দ (ভারত) – এটি একটি হানাফি মাজহাবভিত্তিক প্রতিষ্ঠান।
বাংলাদেশের আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম (হাটহাজারী), জামিয়া রহমানিয়া, হেলালিয়া, আরাবিয়া, গওহরডাঙ্গা ইত্যাদি সব কওমি মাদ্রাসা হানাফি ফিকহ শিক্ষায় পারদর্শী।
🔹 ফতোয়া ও ইজতিহাদ:
দারুল ইফতা থেকে প্রদত্ত ফতোয়াগুলো হানাফি মাজহাব অনুসারে ইস্যু হয়।
জামিয়াতুল উলুম, বেফাক, আল হাইআতুল উলয়া — সব কওমি বোর্ড হানাফি ভিত্তিক।
🕌 ৪. ইবাদতের রীতিনীতি
| বিষয় | বাংলাদেশে প্রচলিত রীতি | হানাফি উৎস |
|---|---|---|
| নামাজে হাত বেঁধে পড়া | নাভির নিচে | হানাফি বিধান |
| রফউল ইয়াদাইন না করা | প্রচলিত | হানাফি রীতি |
| ঈদের নামাজে ৬ তাকবির | অধিকাংশ অনুসরণ করে | হানাফি অভিমত |
| তিন তালাক একসাথে দিলে কার্যকর | প্রচলিত রায় | হানাফি মত |
🤝 সামাজিক রীতি ও সংস্কৃতিতে প্রভাব
নিকাহ, তালাক, ইদ্দত, মেহের, কবর জিয়ারত, জানাযা ইত্যাদি সব রীতিনীতিতে হানাফি প্রভাব।
ইসলামী দাওয়াতি সংগঠন যেমন তাবলিগ জামাত, জমিয়তে উলামা, হেফাজতে ইসলাম — সবই হানাফি ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে পরিচালিত।
⚠️ সাম্প্রতিককালে কিছু ভিন্ন মতের উপস্থিতি
আহলেহাদীস (হাদীসপন্থী) কিছু মানুষ সৌদি আরব বা সালাফি চিন্তাধারায় আকৃষ্ট হয়ে হানাফি বিরোধী কিছু অভ্যাস গ্রহণ করছে, যেমন: রফউল ইয়াদাইন, আমীন জোরে বলা।
তবে এখনও মোট জনসংখ্যার ৯০-৯৫% মুসলমান হানাফি মাজহাব অনুসরণ করে।
✅ উপসংহার:
বাংলাদেশে হানাফি মাজহাব শুধু একটি ধর্মীয় মত নয়, বরং ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনযাপনের একটি প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতি।
এটি ইতিহাস, শিক্ষা, বিচার ও সংস্কৃতির মাধ্যমে গভীরভাবে সমাজে প্রোথিত হয়েছে।