বাংলাদেশে সুন্নি ও শিয়া মুসলমানদের সম্পর্ক তুলনামূলকভাবে শান্তিপূর্ণ হলেও কিছু ঐতিহাসিক, ধর্মীয় ও সামাজিক বাস্তবতা রয়েছে যা এই সম্পর্কের ধরন নির্ধারণ করে। নিচে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি বিশ্লেষণ তুলে ধরা হলো—ধর্মতাত্ত্বিক পার্থক্য থেকে শুরু করে সামাজিক সহাবস্থান, রাজনৈতিক প্রভাব ও সাম্প্রতিক ঘটনাবলি পর্যন্ত।
🕌 ১. ধর্মীয় গঠন ও পরিসংখ্যান
| ধর্মীয় সম্প্রদায় | আনুমানিক অনুপাত |
|---|---|
| সুন্নি মুসলমান | ৯৬–৯৮% (প্রধানত হানাফি মাজহাব) |
| শিয়া মুসলমান | ১–২% (মূলত ইমামিয়া বা জাফরি মাজহাব) |
🔹 বাংলাদেশ একটি সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ, বিশেষ করে হানাফি মাজহাবের প্রভাব প্রবল।
🔹 শিয়া সম্প্রদায় ক্ষুদ্র হলেও তারা সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় চর্চায় সক্রিয়, বিশেষ করে ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও বগুড়ায়।
📜 ২. ঐতিহাসিক পটভূমি
🕰️ মুঘল ও বৃটিশ আমলে:
মুঘল আমলে শিয়ারা প্রশাসনে (বিশেষত পারস্য থেকে আগত পরিবার) বিভিন্ন পদে নিয়োজিত ছিল।
বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলা ও তার পূর্বপুরুষদের মধ্যে শিয়া চেতনা ছিল বলে ইতিহাসে উল্লেখ আছে।
🕌 পুরান ঢাকার হোসেনি দালান:
মুঘল শাসনামলে প্রতিষ্ঠিত (১৬৪২ খ্রিস্টাব্দ)।
এটি বাংলাদেশের শিয়া সম্প্রদায়ের প্রধান কেন্দ্র এবং আশুরার তাজিয়া মিছিলের সূচনাস্থল।
✝️ ৩. ধর্মীয় রীতি ও চর্চা
🔸 শিয়া সম্প্রদায়:
আশুরা উপলক্ষে কারবালার শোক পালন, তাজিয়া মিছিল, মাতম, নওহা পাঠ ইত্যাদি পালন করে থাকে।
ঈমামদের জন্ম ও শাহাদাত দিবস পালন করে।
🔸 সুন্নি সম্প্রদায়:
আশুরায় রোজা রাখা, দান-খয়রাত করা, করুণা স্মরণ করলেও তাজিয়া বা মাতমের চর্চা করে না।
অনেক সুন্নি আলেম শিয়া রীতিকে বিদআত বা শিরকসম বলে থাকেন।
🤝 ৪. পারস্পরিক সম্পর্ক ও সহাবস্থান
✅ ইতিবাচক দিক:
বাংলাদেশে সুন্নি ও শিয়া উভয় সম্প্রদায় সামাজিকভাবে একসাথে বাস করে — বিবাহ, ব্যবসা, পড়াশোনা বা পেশাগত ক্ষেত্রে বিরোধ নেই।
ধর্মীয় মতভেদ থাকলেও সরকারি নীতিমালায় সবাই নাগরিকভাবে সমান, কোনো আলাদা আইন নেই।
⚠️ চ্যালেঞ্জ ও উত্তেজনা:
শিয়া সম্প্রদায়ের ধর্মীয় রীতির বিরুদ্ধে মাঝে মাঝে উগ্রপন্থী সুন্নি গোষ্ঠীর তীব্র সমালোচনা দেখা যায়।
২০১৫ সালের ২৪ অক্টোবর আশুরা উপলক্ষে হোসেনি দালানের কাছে বোমা হামলায় শিয়া মুসল্লিদের উপর সন্ত্রাসী হামলা হয়, যেখানে প্রাণহানি ঘটে।
🏛️ ৫. সরকার, মিডিয়া ও আলেম সমাজের ভূমিকা
🔹 সরকারি নীতি:
ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিসেবেও শিয়াদের উপাসনার পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে।
আশুরা ও মহররমে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়।
🔹 মিডিয়া:
মূলধারার মিডিয়া সাধারণত উভয় সম্প্রদায়ের কার্যক্রম কভার করে, তবে মতবিরোধ তুলে ধরা হয় না।
🔹 আলেম সমাজ:
কিছু সুন্নি আলেম শিয়াদের ইসলামবিরোধী বলে ফতোয়া দিয়েছেন (বিশেষত সালাফি বা আহলেহাদীস ঘরানা থেকে)।
আবার অনেক দেওবন্দি ও মাযহাবপন্থী আলেম শিয়াদের মুসলমান মনে করেন, তবে তাদের আক্বীদাকে ‘ভুল’ বা ‘গোমরাহি’ হিসেবে চিহ্নিত করেন।
🌐 ৬. সামাজিক উপলব্ধি
| বিষয়ে | সমাজে প্রচলিত মত |
|---|---|
| শিয়া মুসলমান কি? | সাধারণ মানুষ মুসলমান বলেই মেনে নেয় |
| আশুরার তাজিয়া | কেউ কেউ দেখেন ‘নাটক’, কেউ শ্রদ্ধার চোখে |
| সুন্নি-শিয়া বিবাহ | সাধারণত কম হয়, তবে আইনগত বাধা নেই |
| রাজনৈতিক প্রভাব | শিয়া সম্প্রদায়ের সরাসরি প্রভাব নেই, তবে শিক্ষিত ও সাংস্কৃতিকভাবে সক্রিয় |
✅ উপসংহার:
বাংলাদেশে সুন্নি ও শিয়া মুসলমানদের মধ্যে সম্পর্ক মোটামুটি শান্তিপূর্ণ হলেও ধর্মতাত্ত্বিক দূরত্ব ও কিছু সামাজিক বিভ্রান্তি আছে।
এই বিভাজনকে কেন্দ্র করে সহিংসতা খুব কম হলেও, উগ্রবাদ ও বিদেশি প্রভাব না থাকলে এটি একটি সহনশীল সহাবস্থান হিসেবে বলা যেতে পারে।
“মতভেদ থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু শত্রুতা নয়।”