**মিষ্টি নয় বৃষ্টি প্রেমের গল্প**
বাইরে ঝুম বৃষ্টি। কলকাতার গলিগুলো যেন জলের তলায় ডুবে গেছে। রাস্তায় গাড়ির হর্ন আর পথচারীদের ছাতার খটখট শব্দ মিলেমিশে এক অদ্ভুত সুর তৈরি করছে। এই বৃষ্টির মাঝে একটি ছোট্ট কফি শপে বসে আছে শ্রেয়া। জানালার কাচে বৃষ্টির ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছে, আর শ্রেয়ার মনও যেন সেই ফোঁটার সঙ্গে কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে। তার হাতে এক কাপ কফি, কিন্তু সেটা ঠান্ডা হয়ে গেছে। শ্রেয়ার চোখে একটা অদ্ভুত শূন্যতা, যেন বৃষ্টি শুধু বাইরেই নয়, তার মনের মধ্যেও ঝরছে।
দোকানের দরজায় ঘণ্টি বাজল। শ্রেয়া তাকাল না। বৃষ্টির শব্দে তার মন ডুবে ছিল। কিন্তিক সংহে একজন ছেলে এসে তার সামনের চেয়ারে বসল। ভিজে চুল, জামা থেকে টপটপ করে জল পড়ছে। ছেলেটি হাসল, “এমন বৃষ্টিতে কফি শপে একা? সিনেমার সিন লাগছে না?”
শ্রেয়া ভ্রু কুঁচকে তাকাল। “আপনি কে?”
“আমি অর্ণব। আর তুমি... বোধহয় বৃষ্টির গল্পের নায়িকা।” ছেলেটির হাসিতে একটা দুষ্টুমি ছিল, কিন্তু তার চোখে কিছু একটা ছিল যা শ্রেয়ার মন ছুঁয়ে গেল।
শ্রেয়া হাসল না। “আমি গল্পের নায়িকা নই। আর এটা কোনো রোমান্টিক সিনেমাও নয়।”
অর্ণব কফি অর্ডার দিয়ে বলল, “তাহলে কী? একটা দুঃখের গল্প?”
শ্রেয়া চুপ করে গেল। তার মনে পড়ে গেল দুই বছর আগের এক বৃষ্টির দিন। সেই দিনও এমন ঝড়-বৃষ্টি ছিল। আর সেই দিনই তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভালোবাসা, রাহুল, তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। কোনো কারণ ছাড়াই। শুধু একটা চিঠি রেখে, যেখানে লেখা ছিল, “আমি তোমার জন্য যথেষ্ট নই। ভালো থেকো।” সেই থেকে শ্রেয়ার জীবন যেন থমকে গেছে। বৃষ্টির দিনগুলো তার কাছে আর মিষ্টি নয়, বরং একটা বেদনার স্মৃতি।
অর্ণব তার চুপ থাকা লক্ষ্য করে বলল, “জানো, বৃষ্টির দিনে আমার মনে হয়, আকাশটা তার সব কষ্ট ঝরিয়ে দিচ্ছে। তুমি কি কখনো তোমার কষ্ট ঝরিয়ে দিয়েছ?”
শ্রেয়া অবাক হয়ে তাকাল। “আপনি এত কথা বলেন কেন? আমাকে চেনেন না, তবু...”
“কখনো কখনো অচেনা মানুষের সঙ্গেই সবচেয়ে বেশি কথা বলা যায়। কারণ তারা জাজ করবে না।” অর্ণবের গলায় একটা আন্তরিকতা ছিল।
শ্রেয়া কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। অর্ণব ঠিকই বলেছে। তার বন্ধুরা, পরিবার—সবাই তাকে বলে, “রাহুলকে ভুলে যা। নতুন করে শুরু কর।” কিন্তু কেউ বোঝে না, ভোলা এত সহজ নয়। অর্ণবের সঙ্গে কথা বলতে তার কেন যেন ভালো লাগছে।
“আচ্ছা, তুমি কেন এত ভিজে এলে?” শ্রেয়া প্রসঙ্গ পাল্টাল।
অর্ণব হাসল। “আমার একটা অদ্ভুত অভ্যাস। বৃষ্টি হলে আমি ছাতা নিই না। মনে হয়, বৃষ্টির ফোঁটাগুলো আমার সব দুঃখ ধুয়ে দিচ্ছে।”
“আর যদি দুঃখ না ধোয়া যায়?” শ্রেয়ার গলায় একটা কষ্ট ঝরে পড়ল।
অর্ণব গম্ভীর হয়ে বলল, “তাহলে সেই দুঃখকে জড়িয়ে ধরতে হয়। তাকে ভয় পেলে চলবে না। তুমি কি তোমার দুঃখকে জড়িয়ে ধরেছ?”
শ্রেয়া চোখ নামিয়ে নিল। তার মনে হল, এই অচেনা ছেলেটি যেন তার মনের কথা পড়ে ফেলছে। কফি শপের বাইরে বৃষ্টি আরও জোরে ঝরছে। দুজনেই চুপ। শুধু বৃষ্টির শব্দ আর কফির গন্ধ তাদের মাঝে একটা অদ্ভুত সেতু তৈরি করছে।
“তুমি কি কখনো ভালোবেসেছ?” শ্রেয়া হঠাৎ প্রশ্ন করল।
অর্ণব একটু থমকে গেল। তারপর বলল, “হ্যাঁ। কিন্তু সে আমাকে বোঝেনি। আমি তাকে সব দিয়েছিলাম, কিন্তু সে শুধু আমার ভুলগুলো দেখত। একদিন সে চলে গেল। আমি ভেবেছিলাম, আমার জীবন শেষ। কিন্তু জানো, বৃষ্টির দিনগুলো আমাকে শিখিয়েছে, ভালোবাসা মানে শুধু পাওয়া নয়, ছেড়ে দেওয়াও।”
শ্রেয়ার চোখে জল চিকচিক করে উঠল। অর্ণবের কথাগুলো যেন তার হৃদয়ের গভীরে গিয়ে আঘাত করছে। সে বলল, “কিন্তু ছেড়ে দেওয়া এত কঠিন কেন?”
“কারণ আমরা ভালোবাসার স্মৃতিগুলোকে আঁকড়ে ধরি। কিন্তু জানো, স্মৃতিগুলো বৃষ্টির ফোঁটার মতো। ধরে রাখতে গেলে হাত থেকে গলে পড়ে। ছেড়ে দিলে তবেই নতুন ফোঁটা আসে।”
শ্রেয়া অর্ণবের দিকে তাকাল। তার চোখে একটা অদ্ভুত শান্তি। যেন এই ছেলেটির কথায় তার মনের জট খুলে যাচ্ছে। বৃষ্টির শব্দে তার মনে হল, হয়তো এই বৃষ্টি তার দুঃখ ধুয়ে দিতে পারে।
ঘণ্টাখানেক কথা হল দুজনের। অর্ণবের জীবনের গল্প, তার স্বপ্ন, তার হাসি—সবকিছুই শ্রেয়ার কাছে নতুন একটা জানালা খুলে দিল। সে বুঝল, জীবন থেমে থাকে না। বৃষ্টি যেমন ঝরে, তেমনই জীবনও এগিয়ে যায়।
বৃষ্টি থামল। অর্ণব উঠে পড়ল। “চলি। আবার দেখা হবে।”
শ্রেয়া হাসল। “হয়তো।”
অর্ণব চলে গেল। শ্রেয়া জানালার দিকে তাকাল। বৃষ্টি থেমে গেছে, কিন্তু আকাশে এখনো মেঘ। তার মনে হল, তার মনের মেঘও যেন একটু হালকা হয়েছে। সে রাহুলের চিঠিটা ব্যাগ থেকে বের করল। অনেকদিন পর সেটা খুলল। পড়ল না। শুধু হাসল। তারপর চিঠিটা ছিঁড়ে ফেলে দিল।
বাইরে আবার বৃষ্টি শুরু হল। কিন্তু এবার শ্রেয়ার মনে হল, এই বৃষ্টি আর দুঃখের নয়। এই বৃদ্ধি নতুন শুরুর। সে কফি শপ থেকে বেরিয়ে এল। ভিজতে ভিজতে হাঁটতে লাগল। তার মুখে একটা হাসি ছিল। অর্ণবের কথা মনে পড়ল— “বৃষ্টি ধুয়ে নয়, নতুন করে শুরু করে।”
শ্রেয়া হাঁটছে। বৃষ্টির ফোঁটায় তার মন যেন নতুন এক গল্প লিখছে। এক গল্প, যেখানে দুঃখ নেই, শুধু ভালোবাসা আর নতুনত্ব।